বিদ্যুৎ সরবরাহের জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়ের কারণে মঙ্গলবার (৪ অক্টোবর ২০২২) চার থেকে আট ঘণ্টার বেশি সময় বিদ্যুৎবিহীন ছিল বৃহত্তর ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লাসহ দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ। যমুনা নদীর পূর্ব পাড়ের জেলাগুলোকে জাতীয় গ্রিডের পূর্বাঞ্চল ধরা হয়। মূলত ওই অংশটিই ‘ফেইল’ করেছে। দেশের প্রকৌশলীরা জাতীয় গ্রিড বিপর্যয় সামাল দিতে নিরলসভাবে কাজ করছেন। জরুরি অবস্থায় তাঁদের নিরন্তর চেষ্টা আন্তরিক ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।
জাতীয় গ্রিডের বিপর্যয়কে একটা দেশের বিদ্যুৎ খাতের বড় পরিকল্পনা ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যর্থতা হিসেবে বিবেচনা করা যায়, কেননা এতে দেশের অর্থনীতির সমূহ ক্ষতি হয়। সরকার প্রাথমিক জ্বালানি বাঁচাতে কয়েক মাস ধরেই পরিকল্পিত লোডশেডিং করছে। ডায়নামিক ও ভাইব্রেন্ট বলে পাওয়ার সিস্টেমে চাইলেই বিদ্যুৎ উৎপাদন-সঞ্চালন-বিতরণ এই তিনের আন্তসম্পর্কে পরিকল্পনাহীন তাৎক্ষণিক কোনো ছেদ টানা যায় না। বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদিত এসি বিদ্যুৎ ব্যাটারিতে চার্জ হিসেবে সংরক্ষণ করা যায় না বলে চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে উৎপাদন করতে হয়। অর্থাৎ বিদ্যুতের চাহিদা এবং উৎপাদনের মধ্যে রিয়েল টাইম সমন্বয় রাখতে হয় বলে। তাই দেশব্যাপী পরিকল্পিত লোডশেডিং বিশদ পরিকল্পনা ও উৎপাদন সমন্বয়ের বিষয়।
লোডশেডিং কাজটি মূলত ‘ন্যাশনাল লোড ডিসপ্যাচ সেন্টার’ বা ‘এনএলডিপিসি’র মাধ্যমে করা হয়। লোড চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন ও সঞ্চালনের বহুপক্ষীয় সমন্বয় পরিকল্পনা, লোডশেডিংয়ের তাৎক্ষণিক ফিজিবিলিটি স্টাডি দরকার। সরকারের জ্বালানি বাঁচানোর সিদ্ধান্তের কারণে বিদ্যুৎ প্রকৌশলীদের ওপর বিশাল কাজের বাড়তি চাপ পড়েছে। কোথাও ভুল হলেই মহাবিপদ।
লোডশেডিং ব্যবস্থাপনার সঙ্গে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র সচল-বন্ধের সমন্বয়হীনতা থাকলেও জাতীয় গ্রিড বিপর্যয় হতে পারে।
বড় কেন্দ্র ভুলে বন্ধ করা হলে, কিংবা জ্বালানি সরবরাহের অভাবে বন্ধ হলে অথবা কারিগরি কোনো ত্রুটিতে বন্ধ হলে তখন গ্রিডের অপরাপর বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপর অত্যধিক চাপ পড়ে কিংবা লো ফ্রিকোয়েন্সি ট্রিগার করলে সেগুলো ফেইল করতে পারে। এতে জাতীয় গ্রিড বিপর্যয় ত্বরান্বিত হয়। পাশাপাশি আরও বহু কারণে জাতীয় গ্রিড বিপর্যয় হতে পারে। ভুল অ্যালার্মে বিদ্যুৎকেন্দ্রের রিলে ট্রিপ করলে কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যেতে পারে। নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ না থাকলে এমন হতে পারে। দেশের সর্বত্রই যেখানে জবাবদিহির অভাব, সেখানে বিদ্যুৎ বিভাগের কারিগরি ও নাজুক কাজে নিখুঁত রক্ষণাবেক্ষণ চর্চা ও জবাবদিহি আশা করা যায় না।
উৎপাদনের বিপরীতে হঠাৎ লোড বৃদ্ধির হার খুব কম সময়ে খুব বেশি হলেও গ্রিড বিপর্যয় হতে পারে। অথবা জাতীয় সঞ্চালন লাইনের কোনো অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে (প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট), সঞ্চালন লাইনের যন্ত্রপাতির মেয়াদ ফুরালে (লাইফ সাইকেল), বা নষ্ট হলেও গ্রিড বিপর্যয় হতে পারে। এ ছাড়া স্ক্যাডা সিস্টেমের সফটওয়্যারে সাইবার আক্রমণের মাধ্যমেও গ্রিড বিপর্যয় হতে পারে, তবে এখন পর্যন্ত পিজিসিবি তেমন আলামত পায়নি।
জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিড বিপর্যয়ের নেপথ্যে কী?
পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ ইয়াকুব ইলাহী চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘ঘোড়াশালে গ্রিড বা বিদ্যুৎ সরবরাহের কোনো একটি লাইন ট্রিপ করেছে। সেই লাইনটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে অন্য লাইন ওভারলোড হয়ে সেটা ট্রিপ করেছে। এর ফলে পূর্বাঞ্চলের গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বল্পতা দেখা দেয়।’
বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের বিষয়ে বিদ্যুৎ সচিব মো. হাবিবুর রহমান বলেছেন, ঘোড়াশাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুটি সাব-স্টেশনের মাঝখানে যে ইন্টার কানেকশন রয়েছে, সেখানেই মূলত সমস্যা। কিন্তু সমস্যাটা কেন হলো সেটা এখনো জানা যায়নি।
প্রাথমিকভাবে আমরা জেনেছি, ঘোড়াশাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র-৭-এ গতকাল ‘ফুল লোড’ দিতে গেলে সমস্যার সূত্রপাত হয়। ৩৬৫ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নতুন হলেও কয়েক মাস ধরেই মধ্যমানে লোড নিচ্ছিল। তবে চীনা বিদ্যুৎকেন্দ্রটিকে আগে ‘ফুল লোড টেস্ট’ করা হয়েছে কি না, সেটা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে স্বচ্ছভাবে জানাতে হবে। কেন্দ্রটি ফেইল করলে তা ঘোড়াশালের অপরাপর বিদ্যুৎ উৎপাদনের ইউনিটে অতিরিক্ত লোড তৈরি করে এবং সেগুলোও ব্যর্থ হয়। ঘোড়াশালের কেন্দ্রগুলো ফেইল করলে সমস্যা হলো ঈশ্বরদীর বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ওভারলোডেড করে ধারাবাহিকভাবে সমস্যা আশুগঞ্জ ও সিরাজগঞ্জের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে বিস্তৃত হয়।
ঘোড়াশালে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পূর্বাঞ্চলীয় গ্রিডে ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট উৎপাদনের ঘাটতি ছিল, এতে গ্রিড ক্যাসকেডিং ব্যর্থ হয়। তবে নতুন আরেকটি বড় চীনা বিদ্যুৎকেন্দ্র পায়রার কারণে সমস্যা পশ্চিমাঞ্চলীয় গ্রিডে ছড়িয়ে পড়েনি, পশ্চিমাঞ্চলীয় গ্রিডে বিদ্যুতের চাহিদাও কম।
গ্রিড বিপর্যয়ের প্রটেকশন মেকানিজম কাজ করেনি কেন?
হাজার মেগাওয়াটের কিছু কেন্দ্র গ্রিড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ক্যাসকেডিং সমস্যা তৈরি করেছে বলে পূর্বাঞ্চলে গ্রিড ফেইল করেছে। একবার গ্রিড ফেইল করলে সেখানে তাৎক্ষণিকভাবে চক্রাকার সমস্যা তৈরি হয়, এ সময় ৫০ হার্জের ফেইজ ফ্রিকোয়েন্সি দ্রুত কমে গিয়ে আন্ডারফ্রিকোয়েন্সি ট্রিপ শুরু হয়। এতে অপরাপর বিদ্যুৎকেন্দ্র একে একে বন্ধ হতে শুরু করে। এ সময় দ্রুততার সঙ্গে লোড বন্ধ করতে হয়। গতকালের ঘটনাটি এত দ্রুত ঘটেছে যে লোড শাটডাউন করে ফ্রিকোয়েন্সি ব্যালান্স করার সময় পাননি প্রকৌশলীরা।
কিন্তু এ রকম পরিস্থিতি মোকাবিলা করার মানবসম্পদ, কারিগরি সক্ষমতা, স্ক্যাডা ও এনএলডিসিতে যৌক্তিক বিনিয়োগ করা হয়েছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা যৌক্তিক। বিদ্যুৎকেন্দ্র চালুর সময় আবার ৫০ হার্জের ফেইজ সিনক্রোনাইজেশন ঠিক করে চালু করা লাগে। সব মিলে গ্রিড-রিস্টোর করতে বেশ সময় লাগে।
গ্রিড বিপর্যয় ঠেকানোর জন্য কিছু ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, কিন্তু সেসবও কাজ করেনি। অর্থাৎ স্ট্যান্ডবাই ব্ল্যাকআউট স্টার্ট জেনারেটরগুলো চালু হয়নি। ময়মনসিংহ আরপিসিএল, সিলেট, সৈয়দপুর, কাপ্তাই কোথাও গ্রিড বিপর্যয় প্রোটেকশন ঠেকানোর জন্য স্ট্যান্ডবাই রাখা ২০ মেগাওয়াটের ‘ব্ল্যাক স্টার্ট’ জেনারেটরগুলো কাজ করেনি। কেন, তার উত্তর খোঁজা উচিত।
লো ফ্রিকোয়েন্সি সমস্যা সমাধানে প্রকৌশলীরা অলস কিন্তু বসিয়ে বসিয়ে ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া বেসরকারি ভাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে সচলের নির্দেশ দিয়েছেন কিন্তু বেসরকারি ভাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের কোনোটাকেই উৎপাদনে আনা যায়নি। যে কারণে গ্রিড পুনঃ সচল করতে প্রকৌশলীদের অনেক দেরি হয়েছে। বেসরকারি বিদ্যুৎ খাতে বিগত এক যুগে অন্তত ৭০ হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জের ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে। আমরা প্রশ্ন করেছি, এসব কেন্দ্রের সক্ষমতা আদৌ পরীক্ষিত এবং প্রমাণিত কি না?
সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে বহু বেসরকারি ভাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্র মিথ্যা সক্ষমতার বিপরীতে অলস থেকে রাষ্ট্রের বাজেট বরাদ্দ হাতিয়ে নিচ্ছে। এসব কেন্দ্রের অনেকগুলো উৎপাদনে যেতেই অক্ষম। মালিকেরা সরকারের প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে আঁতাত করে দুর্বৃত্তপ্রক্রিয়ায় ভাড়াভিত্তিক ভুয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা দেখাচ্ছেন, যা দেশের স্বাভাবিক ও জরুরি প্রয়োজনে কোনোই কাজে আসছে না।
একটি উপলব্ধি হচ্ছে, ১১০০ মেগাওয়াট লোড ঘাটতিজনিত বিপর্যয়ে আন্ডারফ্রিকোয়েন্সিজনিত ট্রিপ সামাল দেওয়ার সক্ষমতা অটো-লোডশেডিং সিস্টেমের ছিল না। আন্ডারফ্রিকোয়েন্সি প্রোটেকশন সিস্টেমের সক্ষমতা মাত্র অর্ধেক ছিল। পাশাপাশি আরেকটি উপলব্ধি পূর্ব-পশ্চিমের গ্রিডে বিদ্যুৎ চাহিদা বিন্যাসে সমন্বয় নেই। পশ্চিম গ্রিডে শিল্পায়ন পরিকল্পনার সমন্বয় নেই বলে পূর্বে চাপ বেশি। পূর্ব গ্রিডে লোড সেন্টারের কাছাকাছি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র কম।
বিদ্যুৎ সিস্টেম স্ক্যাডা সেকেলে এবং স্ক্যাডা বিনিয়োগ অপর্যাপ্ত কেন?
স্ক্যাডা হচ্ছে সুপারভাইজরি কন্ট্রোল অ্যান্ড ডেটা একুইজেশন। এর মাধ্যমে লোড ডিমান্ডের সঙ্গে উৎপাদন ও সঞ্চালন সম্পর্ক ঠিক রাখা হয়। পিক-অফ পিকে দরকারে উৎপাদন বাড়ানো কমানো হয়। সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনে লোড বেড়ে গেলে প্রয়োজনে লোডশেডিং করা হয়। স্ক্যাডা হচ্ছে প্রোগ্রামেবল লজিক কন্ট্রোলভিত্তিক (পিএলসি) বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা নেটওয়ার্ক।
বাংলাদেশের স্ক্যাডা ১২ বছর পুরোনো। সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের মতে, আদর্শ অনুশীলন হলো প্রতি সাত বছরে স্ক্যাডা সম্পূর্ণরূপে প্রতিস্থাপন করা। সেখানে দক্ষ কারিগরি জনবলের অভাব আছে। অবিলম্বে দশকের পুরোনো স্ক্যাডা সিস্টেম প্রতিস্থাপন করার জন্য বিনিয়োগের প্রয়োজন, অন্যথায় ভবিষ্যতে আরও অন্ধকার আসবে। একটা গুরুতর অভিযোগ হচ্ছে, বাংলাদেশের লোড ডিসপ্যাচ সেন্টার বা এনএলডিপিসির দক্ষ জনশক্তি একেবারেই কম। পিজিসিবি অপ্রয়োজনীয়ভাবে দক্ষ প্রকৌশলীদের প্রযুক্তিগত কাজে ব্যবহার না করে মানবসম্পদ বিভাগ ও প্রশাসনিক কাজে ব্যবহার করছে।
কারিগরি খাতের দক্ষ জনবল প্রশাসনের বিসিএস কর্মকর্তাদের মতো কয়েক বছর পরপর বদলি করে ফেললে দীর্ঘমেয়াদে অতি দক্ষ কারিগরি মানবসম্পদ উন্নয়ন অসম্ভব। সার্বিকভাবে দক্ষ জনবল ধরে রাখতে অভিজ্ঞ প্রকৌশলীদেরকে কারিগরি খাতে রেখেই পদোন্নতির পথ খুঁজতে হবে।
দেশে এক মাসের ব্যবধানে দ্বিতীয়বারের মতো জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটল। গত ৬ সেপ্টেম্বরও মাঝারি গ্রিড বিপর্যয় হয়েছিল, কুষ্টিয়া, যশোরসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলো প্রায় দেড় ঘণ্টা বিদ্যুৎবিহীন ছিল। বাংলাদেশে বড় বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেছিল ২০১৭ সালের ৩ মে। সেবার আকস্মিক গ্রিড বিপর্যয়ের পর উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমের ৩২টি জেলা কয়েক ঘণ্টা ধরে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন ছিল। এর আগে ২০১৪ সালে গ্রিড বিপর্যয় হয়েছিল। অর্থাৎ নিয়মিত বিরতিতেই চলছে গ্রিড বিপর্যয়, এতে অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। সমস্যা সমাধানে সঠিক তদন্ত করে সঠিক কারিগরি ও বিনিয়োগ পদক্ষেপ দরকার। গতানুগতিক তদন্ত ও গল্পনির্ভর রিপোর্ট বানিয়ে চালিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে বিদ্যুতের ‘ব্ল্যাকআউট’ থামবে না।