প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের টাকা কেউ চিবিয়ে খায়নি, মানুষের কাজেই লাগছে।…’বিদেশি অর্থায়নে অনেক ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হয়। সে কারণে আমাদের রিজার্ভের টাকা দিয়ে, সম্পূর্ণ আমাদের টাকা দিয়ে অর্থাৎ বাংলাদেশের যে রিজার্ভ, সেই রিজার্ভের টাকা দিয়ে একটা ফান্ড তৈরি করেছি। এই ফান্ড নামটাও আমি নিজেই দিয়েছিলাম, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ইনফ্রাস্টাকচার ফান্ড (আইডিএফ)। অর্থাৎ, বাংলাদেশ অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিল। এটা তৈরি করি এবং আমদের রিজার্ভের টাকা দিয়ে এই ফাণ্ডটা সৃষ্টি করি। সেই ফান্ড থেকেই আমরা এই বন্দরের ড্রেজিং কাজটা শুরু করেছি।’
জাইকা প্রতিবেদন মতে, হিমালয়ান মিহিপলিবাহিত বৃহৎ নদীগুলোর মোহনার মাত্র সাড়ে দশ মিটার গভীর চ্যানেলে নিয়মিত ক্যাপিটাল ড্রেজিং করে পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর অসম্ভব। অর্থাৎ পায়রা বন্দরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ঋণ প্রদানের সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক ছিল। পায়রা বন্দর নিজেই অকার্যকর থাকে যাবে বলে সরকারও ভুল জায়গায় গভীর সমুদ্রবন্দর পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছেন। তদুপরি এই বন্দর ডলারে আয় করবে না বলে এখানে রিজার্ভ ঋণ পরিকল্পনা সঠিক ছিলনা। ডলারে আয় করবে না, এমন প্রকল্পে রিজার্ভ ঋণে বাংলাদেশ ব্যাংকেরও আপত্তি ছিল।
শুধু ইনফ্রাস্টাকচার ডেভেলপমেন্ট ফান্ডে নয়, বরং সরকার রপ্তানি সহায়তা ফান্ড হিসেবেও ঋণ দিয়েছে সরকার। বহু ব্যবসায়ী ঋণপত্র বা এলসি’র আমদানির ওভার-ইনভয়েসিং করে অর্থপাচার করে বলে সরকারকে অনেকেই সতর্কও করেছিল, কেননা সব ব্যবসায়ী সৎ নয়। উপরন্তু আছে আমলাতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক দুর্বিত্তায়ন ও পাচার। রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের স্বল্পমেয়াদি রিজার্ভ ঋণ কেন ফেরত আসছে না, এর উত্তর নাই। অধ্যাপক ড মইনুল ইসলাম আশংকা করছেন, উল্লেখযোগ্য অংশ পাচার হয়েছে। অর্থাৎ রিজার্ভ থেকে বাছবিচারহীন অবকাঠামো (আইডিএফ) ও রপ্তানি (ইডিএফ) সহায়তা ঋণ দিয়ে দেশের রিজার্ভকে সংকটাপন্ন করার ঝুঁকি নেয়া হয়েছিল।
করোনাকালে আমদানি অনেক বেশি কমে গিয়ে, হুন্ডি বন্ধ হয়ে বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতি উত্তরোত্তর বেড়েছিল। ডিসেম্বর ২০২০ শেষে বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতি ৪২ বিলিয়ন ডলারের বেশি। রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়া কি শক্তিশালী অর্থনীতির চিত্র, নাকি বিনিয়োগ ও মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির স্থবিরতা, আমদানি-রপ্তানিসহ সার্বিক অর্থনীতিরই স্তবিরতা এই আলোচনা প্রাসঙ্গিক থাকলেও পলিসি পর্যায়ে গুরুত্ব পায়নি সেসময়। বাস্তবে, বৈদেশিক রিজার্ভ কখনই অলস নয়। বড় রিজার্ভের বিপরীতে অর্থ প্রত্যাবাসন সহজ হয় বলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা তৈরি হয়। বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে টাকার বিনিময় হার এবং দেশের ঋণমান (ক্রেডিট রেটিং) নির্ধারণে রিজার্ভের গুরুত্ব অপরিসীম। বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট থাকলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে জোগান হয়। বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে টাকার বিনিময় হার যৌক্তিক পর্যায়ে ধরে রাখতে বাজারের চাহিদা অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রায় তারল্য বাড়ানো হয়, ফলে বিনিময় হার দীর্ঘদিন ধরেই স্থিতিশীল। সুতরাং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আসলে অলস পড়ে থাকে না, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে স্থানীয় ও বৈদেশিক মুদ্রাপ্রবাহের ইকোসিস্টেমকে সচল রাখে। তাই রিজার্ভের অর্থের নীতিবিরুদ্ধ বিকল্প ব্যবহারের সুযোগ ছিলনা।
কিছুটা বর্ধিত রিজার্ভ হাতে রেখে সম্ভাব্য যে কোন নতুন সংকট মোকাবেলার দুরদর্শী ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা আমরা দেখিনি। যে ডলার রিজার্ভ ভুল পরিকল্পনায়, ভুল হাতে ঋণ দিয়ে আটকে আছে, সেই ডলারের জন্যই আজকে আমরা আইএমএফ, এডিবি, জাইকার দ্বারে দ্বারে ঘুরছি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ পলিসি ডিপার্টমেন্টের প্রতিবেদনে মতে, ২০২১ সালের আমদানী দায় (মূলত বেসরকারি, তবে সরকারি প্রকল্প সংশ্লিষ্ট আমদানিও আছে) পরিশোধ পিছিয়ে দেয়ার (এলসি ডের্ফাড) ফলে মোট আমদানি দায়ের ৩০ শতাংশই স্বল্পমেয়াদী বৈদেশিক ঋণে পরিণত হয়ে গেছে। ২০২১ সাল পর্যন্ত সৃষ্ট, মোট ১৭ বিলিয়ন বৈদেশিক ঋণের ৫৭ শতাংশই এভাবে কিউমুলেটেড হয়েছে। ফলে ২০২২ সালে এসে বিদেশি ঋণের মোট সরকারি ও বেসরকারি দেনা অস্বাভাবিক পর্যায়ে চলে গেছে। স্বল্পমেয়াদী দায়ের সাথে দীর্ঘমেয়াদী এবং অন্যান্য অভ্যন্তরীণ ঋণ মিলে বর্তমানে বিদেশি ঋণের কিস্তির মোট দেনা ২৩ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে বেসরকারী খাতের দায় প্রায় ১৮ বিলিয়ন দেনা পরিশোধ করতে হবে। বাকি ৫ বিলিয়ন ডলারের কিস্তির দায় সরকার। বেসরকারি কোম্পানিগুলো নিজেরা বিদেশ থেকে যে স্বল্পমেয়াদী ঋণ নিয়েছে, অনেক ক্ষেত্রেই করোনাকালে ঋণের কিস্তি না দিয়ে পুনঃতফসিল করেছে, এতে বিলম্বিত দেনার স্থিতি বেড়েছে। করোনাকালে বেসরকারি পেমেন্ট বন্ধ না থাকলেও, ডলার সংকটে পড়ে এখন সরকার নিজেই বেসরকারি বিল-পেমেন্ট বন্ধ করেছে। এখন বেসরকারিরা বলছে সরকার পেমেন্ট দিচ্ছে না বলে, তারা বিদেশি ঋণে খেলাপি হবার ঝুঁকিতে পড়েছে (ডিফল্টার)। সবমিলে বিদেশি ঋণের সরকারি-বেসরকারি ঋণ পরিশোধের দায়ের (ডেবট সার্ভিসিং) পরিস্থিতি খুব বাজে।
বর্তমানে রিজার্ভ ৩৫ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার (২৬ অক্টোবর)। ইডিএফ ঋণ প্রায় ৭ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া রিজার্ভ থেকে বাংলাদেশ বিমান, পায়রা সমুদ্রবন্দর ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে পড়া শ্রীলঙ্কাকে ঋণ দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে এজন্য মোট দেওয়া হয়েছে প্রায় ৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। আইএমএফর হিসাবে এই অর্থ রিজার্ভ থেকে বিয়োগ করলে প্রকৃত রিজার্ভ দাঁড়ায় ২৭ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সরকারের দেনা আছে ৪ বিলিয়ন ডলার, অপরাপর দায় ও আমদানির জন্য এশিয়ান ক্লিয়ারিং হাউজে দেনা আরও ২ বিলিয়ন ডলার। সাথে আছে বৈদেশিক ঋণের কিস্তি বাবদ দেনা আরও ৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এইমহুর্তে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ আছে মাত্র ১৬ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। এর সাথে যোগ হবে প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয়, কিন্তু সেটা আমদানি ব্যয়ে খরচ হয়ে পড়বে বলে রিজার্ভে যোগ হবে না তেমন। বাংলাদেশ বিগত অর্থবছরে ৩৩ বিলিয়ন ডলার বাণিজ্য ঘাটতি প্রত্যক্ষ করেছে, অর্থাৎ আমাদের রপ্তানির চাইতে আমদানি বিল ৩৩ বিলিয়ন ডলার বেশি ছিল। ফলে প্রবাসী আয় হিসেবে বছরে আসা ২০ বিলিয়ন ডলারও কিন্তু ঋণাত্মক বাণিজ্য ঘাটতি (আমদানি বিয়োগ রপ্তানি) ও বিদেশী ঋণের কিস্তি পরিশোধের পরে রিজার্ভে যুক্ত হবার সম্বাবনা কম। স্বাভাবিক সময়ের হিসেবে বর্তমান রিজার্ভ মাত্র আড়াই মাসের আমদানি বিলের সমান, কিংবা কিছু বেশি। আগাম দুর্ভিক্ষ ঘোষণার রাজনীতির প্রেক্ষাপটটা এখানেই লুকিয়ে আছে!
তর্ক সাপেক্ষে একটা দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল কাজ দুটা, হার্ড ফরেন কারেন্সির অর্থাৎ ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা স্থিতিশীল রাখা এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। বাংলাদেশ এই মুহুর্তে দুটার কোনটাই করতে পারছে না। একদিকে দেশের মূল্যস্ফীতি ১৩ বছরে সর্বোচ্চ, অন্যদিকে ডলারের বিপরীতে টাকার মান ক্রমাগত পড়ছে। ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা স্থিতিশীল রাখতে হলে সরকারকে উচ্চমান রিজার্ভ ধরে রাখতে হবে, দায়দেনা পরিশোধের পরে যেটা সম্ভব হচ্ছে না।
সরকারের হাতে সম্ভ্যাব্য বিকল্প দুটি, আরও অধিকহারে এলসি বন্ধ করা এবং আরওবেশি বৈদেশিক ঋণ করা। এলসি ক্রমাগত বন্ধ হলে, রিজার্ভ কমার হার কমবে, কিন্তু অর্থনীতিতে নতুন বহুমুখী সংকট শুরু হবে। আরওবেশি বৈদেশিক ঋণ নিলে দেনাও বাড়বে। রপ্তানিখাতের কাঁচামাল, ক্যাপিটাল মেশিনারিসহ জরুরি আমদানি বন্ধ করতে হবে। ইতিমধ্যেই সরকার রিজার্ভ বাঁচাতে প্রাথমিক জ্বালানি আমদানি কমিয়েছে, এতে বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রেখে পরিকল্পিত লোডশেডিং হচ্ছে। চলমান ভয়াবহ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট জনজীবন, কর্মসংস্থান, শিল্প উৎপাদন সহ সার্বিক অর্থনীতিতে বিপর্যয় তৈরি করেছে।
সরকার ফেব্রুয়ারি থেকেই এলসি নিষ্পত্তি নিয়ন্ত্রণ করে আসছে, এতে আমদানি ব্যয় কিছুটা কমেছে, তবে খোলাবাজারে ডলার সংকট বেড়েছে। অর্থাৎ বাজারে ডলার ছাড়তে হচ্ছে বলে, ঋণপত্র বন্ধ করেও রিজার্ভ হ্রাসের সমস্যা থামছে না। রিজার্ভ হ্রাসের ঝুঁকির মধ্যেও সরকারকে খাদ্য নিরাপত্তা ও জ্বালানি নিরাপত্তা সুরক্ষিত রাখতে খাদ্যপণ্য, সার, ডিজেল গ্যাস সহ জ্বালানি ও অপরাপর জরুরি আমদানি চালিয়ে যেতে হবে।
দুর্ভিক্ষ ঘোষণার রাজনীতিটার উৎস দুটা। একটা হচ্ছে, সম্ভাব্য বৈশ্বিক মন্দায় আগামীর দিনে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় হ্রাসের সম্ভাব্য ঝুঁকি। অন্যটা একটা হচ্ছে, ওপেক ভুক্ত দেশের জ্বালানি উৎপাদন কমিয়ে আনা সহ ইউক্রেন যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি। যেহেতু সরকার আগেই রিজার্ভের ডলার ভুল জায়গায় ও ভুল হাতে খরচ করে রেখেছে, একইসাথে তার অধিক পরিমাণ বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধের চাপ আছে, তাই সরকার ভয় পেয়ে বসেছে। এমতাবস্থায় রিজার্ভ ধরে রাখতে হয়ত সরকারকে খাদ্য, সার, কাঁচালামসহ বহু জরুরি আমদানির এলসিও বাতিলের কঠিন সব সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে। অর্থাৎ ডলারের বিপরীতে টাকার আরও পতন ঠেকানো, কিংবা সরকারি ও বেসরকারি ঋণের দেনার ভারে নির্বাচনের আগে দেউলিয়া হওয়ার কাছাকাছি পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে পরিকল্পিত জ্বালানি সংকটের মত, সার ও খাদ্য আমদানি বন্ধ করে পরিকল্পিত খাদ্য সংকটের পথেও হাঁটতে হতে পারে। আগাম দুর্ভিক্ষ ঘোষণার রাজনীতিটা এটাই! এর মাধ্যমে নিজস্ব ভুল পরিকল্পনার সংকটকে ইউক্রেন যুদ্ধ ও বিশ্বমন্দার উপর সওয়ার করার ‘রাজনৈতিক’ বয়ান তৈরি করা হচ্ছে মাত্র। বাংলাদেশের আজকের সংকট আমাদের উপর শতভাগ আরোপিত নয়, বরং আমরা নিজেরাই চলমান ডলার সংকটের একটা বড় অংশের নির্মাতা।