সম্প্রতি বণিক বার্তার পক্ষ থেকে আমাকে বলা হয় যে, পত্রিকাটি ড. আকবর আলি খানকে বিশেষ সম্মাননা দিতে যাচ্ছে। এ উপলক্ষে তারা তাঁকে নিয়ে কয়েকটি লেখা প্রকাশ করতে আগ্রহী। পত্রিকাটির পক্ষ থেকে ড. খানকে জিজ্ঞেস করা হয় কাদেরকে তাঁর সম্পর্কে লিখতে অনুরোধ করা যায়। আমি শুনেছি, তিনি যে কয়জনের নাম প্রস্তাব করেছেন তার মধ্যে আমিও একজন, যা শুনে আমি একদিকে যেমন আশ্চার্যান্বিত হয়েছি, তেমনিভাবে সম্মানিতও বোধ করছি। আশ্চর্যান্বিত হওয়ার কারণ দীর্ঘদিন বিদেশে থাকার ফলে তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে মেলামেশা কিংবা পেশাগতভাবেও কাজ করার তেমন সুযোগ হয়নি। এছাড়াও ড. আকবর আলি খান অত্যন্ত ‘প্রাইভেট’ মানুষ বলেই আমার ধারণা – বাঙালির অতি প্রিয় ‘পাস্টটাইম’ আড্ডা দেওয়ার মানুষ তিনি নন। বরং একজন বই-পোকা এবং নীরবে-নির্ভৃতে কাজ করার মানুষ তিনি।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফেরার পর গত ৩০ বছরে যদিও ড. আকবর আলি খানের সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমার একাধিকবার দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে, এমনকি তাঁর বাসায় গিয়েও কয়েকবার আলাপ করেছি, চা খেয়েছি। তবে তত্ত¡াবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে পদত্যাগের পর তাঁর সঙ্গে আমার একাধিকবার অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ সময়ের জন্য আলাপ হয়। এসব আলাপে তিনি মূলত আমার এবং আমাদের (সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক) কার্যক্রম সম্পর্কেই জানতে চেয়েছেন। তাই ব্যক্তিগতভাবে ড. খান এবং তাঁর কার্যক্রম সম্পর্কে গভীরভাবে জানার কখনও সুযোগ হয়নি।
তবে আমি জানি যে, ড. আকবর আলি খান আমাকে অনেক পছন্দ করেন। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সুজন-এর জাতীয় সম্মেলনে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আগত সহস্রাধিক ব্যক্তির সামনে আমাকে পছন্দের কথা তিনি প্রকাশ্যভাবে ব্যক্ত করেছেন। অনুষ্ঠানে সুজন-এর বিভিন্ন কাজেরও ভূয়সী প্রশংসা করেন তিনি।
এই লেখা তৈরি করতে গিয়ে আমি ড. আকবর আলি খান সম্পর্কে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানার চেষ্টা করি। ইন্টারনেটেও অনুসন্ধান করি, দুর্ভাগ্যবশত গতানুগতিক তথ্যের বাইরে তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। তাঁর লেখা ‘পুরানো সেই দিনের কথা’ বইটি আমি পড়ি, যে বইতে মূলত আশেপাশের লোকদের, বিশেষত পরিবার সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, কিন্তু নিজেকে জাহির করার থেকে সম্পূর্ণ বিরত থেকেছেন। অর্থাৎ ড. আকবর আলি খানের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে জানার গণ্ডি অত্যন্ত সীমিত। তাই অন্যান্য ঘনিষ্ঠজনের মতো তাঁর সম্পর্কে স্মৃতিচারণমূলক লেখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
সীমিত পরিমাণের ব্যক্তিগত ও পেশাগত মেলামেশা সত্ত্বেও ড. আকবর আলি খান আমার একজন অতি প্রিয় মানুষ। আমার জন্য অনুপ্রেরণার উৎস ও অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর সঙ্গে যখন সাক্ষাৎ হয়, কিংবা কথা বলি, তখন আমি শুধু পুলকিতই হই না, বিস্মিত হই এবং চরম প্রতিক‚লতা অবস্থার মধ্যেও সামনে এগিয়ে যাওয়ার যৌক্তিকতা ও অনুপ্রেরণা খুঁজে পাই। স্ত্রী ও অকালে সন্তানহারা একজন মানুষ, যিনি নিজেও শারীরিকভাবে সুস্থ নন, তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞাপ্রসূত চিন্তা ও অবদান আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য রেখে যাওয়ার লক্ষ্যে কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। চিন্তার খোরাক সৃষ্টি করার পাশাপাশি তাদের বিবেক জাগ্রত করার অবিরাম প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন, অনেক রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করেও। বস্তুত এটাই বুদ্ধিজীবী ও সমাজ চিন্তকদের কাছ থেকে গণমানুষ প্রত্যাশা করে। তাঁর মতো অবস্থায় পৌঁছালে অনেকেই হয়তো সব বাদ দিয়ে ধর্মকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন, কিংবা অন্য কোনোভাবে অবসর জীবন-যাপন করতেন। কিন্তু তাঁর অবস্থান থেকে নিজেকে ভাবলে মনে হয়, ড. আকবর আলি খান যদি এত বাধা-বিপত্তি সত্তে¡ও অসুস্থ শরীর নিয়ে কঠোর পরিশ্রম করতে পারেন, তাহলে আমি কেন পারব না!
ড. আকবর আলি খান নিঃসন্দেহে বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব, গ্রামসির ভাষায় যাঁকে বলা যায় ‘অর্গানিক বুদ্ধিজীবী’। বহু ক্ষেত্রে রয়েছে মেধাবী এ মানুষটির পদাচারণ এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে রেখেছেন পাণ্ডিত্বের স্বাক্ষর। সহজ কথা অতি সহজে বলতে পারাই শুধু নয়, অনেক শক্ত কথাও তিনি সহজে বলতে পেরেছেন। তাঁর সুখপাঠ্য বইগুলো পড়লে এর অসংখ্য দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ, ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’ বইতে তিনি অর্থনীতির মতো একটি নিরস বিষয়কে তিনি যেভাবে সহজ, আকর্ষণীয় ও সৃজনশীলভাবে উত্থাপন করেছেন তা অনেক পাঠকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করেছে, যার ফলে তিনি একজন পাঠক সমাদৃত, অন্য অর্থে বহুল পঠিত লেখক। তাঁর সুপাঠ্য প্রবন্ধের শিরোণামগুলের দিকে তাকালেই – যেমন, শোয়রের বাচ্চাদের অর্থনীতি, মোল্লা নাসিরউল্লিনের অর্থনীতি, খোলা ম্যানহোলের রাজনৈতিক অর্থনীতি ইত্যাদি – তাঁর সৃজনশীলতা ও সত্য বলার স্বাক্ষর মেলে।
ড. আকবর আলি খান আমার একজন প্রিয় মানুষ হওয়ার একটি বড় কারণ তাঁর জীবনাদর্শ। সম্প্রতি সুজনের জাতীয় সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্যে তিনি এথেন্সের ইতিহাসবিদ এবং বিখ্যাত পেলোপোন্নেসিয়ান যুদ্ধের জেনারেল থুসাইদাইদসের একটি উক্তি ব্যবহার করেন। উক্তিটি হলো, ‘The secret to happiness is freedom … and the secret to freedom is courage’। অর্থাৎ সুখের উৎস হলো স্বাধীনতা… আর স্বাধীনতার উৎস হলো সাহস। ড. আকবর আলি খানের জীবনের দিকে তাকালে আমি এ উক্তির পরিপূর্ণ প্রতিফলন দেখতে পাই।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে ১৯৪৪ সালে এক অজপাড়া গাঁয়ে জন্মগ্রহণ করা ড. আকবর আলি খান শৈশব ও কৈশোর থেকেই ছিলেন স্বাধীনচেতা ব্যক্তি, একজন নির্লোভ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মানুষ। নিজের স্বীকৃতি অনুযায়ী তিনি একজন নিষ্পাপ না হলেও জীবনে নীতি-নৈতিকতার অতি উচ্চ মানদণ্ড ব্যবহার করেছেন। তিনি মনেপ্রাণে একজন অসম্প্রদায়িক মানুষও। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছিলেন সর্বদা সোচ্চার। সর্বোপরি পারিবারিক বিপর্যয়, নানা প্রতিকূলতা ও শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও তিনি একজন সুখী মানুষ বলে আমার ধারণা এবং স্বাধীনতার জন্য লড়াকু মনোভাব ও সাহসিকতা তাঁর সহজাত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। আমি নিজেও এমন জীবনাদর্শে বিশ্বাস করি – আর এজন্যই তিনি আমার জন্য অনুসরণীয়।
ড. আকবর আলি খানের স্বাধীনচেতা মানসিকতার একটি দৃষ্টান্ত পাই তাঁর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে। তিনি তাঁর নিজের বয়ানে বলেছেন: ‘… উচ্চ মাধ্যমিকের পর সবাই একবাক্যে উপদেশ দিলেন যে আমি যেন অর্থনীতি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স পড়ি। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় আমি তর্কশাস্ত্র, ইতিহাস, অর্থনীতি এবং বাংলা সাহিত্যে সর্বোচ্চ নম্বর পাই। এই চারটি বিষয়ের মধ্যে আমি ইতিহাসকে বেছে নেই … মরব্বিদের উপদেশ অগ্রাহ্য করে আমি প্রায় জোর করে ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হই।’ (পুরানো সেই দিনের কথা, পৃষ্ঠা: ১৩৮)
ড. আকবর আলি খানের অর্থের প্রতি নির্মোহ মানসিকতার আমরা পরিচয় পাই তাঁর সাদা-মাটা জীবন যাপন এবং নিজের মেধা বিক্রি করে অর্থ আয়ের প্রচেষ্টা থেকে নিজেকে বিরত রাখা থেকে। তাঁর অনেক সতীর্থের মতো তিনি ইচ্ছা করলে অনেক নামী-দামি দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানে অতি উচ্চ পারিশ্রমিকে পরামর্শক হিসেবে কাজ করতে পারতেন। তা না করে তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা ও সার্বক্ষণিকভাবে লেখালেখিতে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন।
ব্যক্তিগত জীবনে ড. আকবর আলি খান প্রতিশোধপরায়ণতা বিবর্জিত ও নির্লোভ মানসিকতাসম্পন্ন একজন মানুষ। এর একটি দৃষ্টান্ত আমরা দেখতে পাই ইউনাইটেড হাসপাতালের অবহেলার কারণে তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর পর হাসপাতালটির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা না নেওয়া থেকে। তাঁর নিজের ভাষায়: ‘ইচ্ছা করলে হাসপাতালের বিরুদ্ধে আমি ক্ষতিপূরণের মামলা করতে পারতাম। আদালত হয়তো আমাকে ক্ষতিপূরণের আদেশ দিতেন, কিন্তু আমার স্ত্রীর প্রাণ তো আর ফিরে আসত না।’ (পুরানো সেই দিনের কথা, পৃষ্ঠা: ৮৪)
অর্থের প্রতি নির্লোভ হলেও আমাদের সমাজে ক্ষমতার লোভ মানুষের প্রায় সবারই একটি মানবিক দুর্বলতা। বস্তুত নীতিগত কারণে গুরুত্বপূর্ণ পদ পরিত্যাগ করার তেমন বড় দৃষ্টান্ত আমাদের সমাজে আছে বলে আমার জানা নেই। এক্ষেত্রে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন ড. আকবর আলি খান ও তাঁর অন্য তিনজন সহকর্মী – সুলতানা কামাল, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) হাসান মশহুদ চৌধুরী ও সিএম শফি সামী – ২০০৬ সালের রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা পদ থেকে পদত্যাগের মধ্য দিয়ে। এটি শুধু এই চারজনের ব্যক্তিগত আত্মত্যাগই ছিল না, এটি ছিল ইতিহাস সৃষ্টিকারী একটি অসামান্য ঘটনা। ২০০৬ সালের ১১ ডিসেম্বর তাঁরা চারজন পদত্যাগ না করলে, এটি প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায় ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ-এর নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদত্যাপ করতো না, ২২ জানুযারি তারিখের নির্ধারিত একতরফা নির্বাচনও সম্ভবত হয়ে যেত, যার ফলে বাংলাদেশের পুরো ইতিহাসই ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হত। তবুও নিয়তির পরিহাস, ড. আকবর আলি খান ও তাঁর সহকর্মীদের একযোগে পদত্যাগের সরাসরি সুবিধাভোগীরাই পরবর্তীতে তাঁদের বিরুদ্ধে নির্বাচন না করতে পারার সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও হাস্যকর অভিযোগ তোলেন।
নীতি-নৈতিকতার কারণে ড. আকবর আলি খান ছিলেন সর্বদা প্রতিবাদী ও আপসহীন। তাঁর পুরানো সেই দিনের কথা বইতে তাঁর বন্ধু মোস্তাফিজুর রহমানের কাছ থেকে একজন কর্মকর্তার বৃত্তির টাকার জন্য উৎকোচ দাবি করলে তিনি এবং তাঁর কয়েকজন সহপাঠী তৎকালীন ডিপিআই শামসুল হকের কাছে গিয়ে প্রতিবাদ করেন। এ প্রতিবাদের কারণে সমস্যাটির সমাধান হয়।
ন্যায়ের ব্যাপারে তাঁর আপসহীনতার আরেকটি দৃষ্টান্ত হলো, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে রাজাকারদের শাস্তি দেওয়ার জন্য রাজাকার দমন আইন পাশ হলে এর আইনগত ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ড. আকবর আলি খান এবং শিক্ষামন্ত্রীকে আইন মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ নিতে বলেন। ‘বঙ্গবন্ধু আদেশ দিয়েছেন। এ আদেশ সম্পর্কে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামতের কোনো প্রয়োজন নেই’- শিক্ষামন্ত্রীর এমন জবাবেও দমে না থেকে তিনি আদেশের খসড়ার সঙ্গে আইনের ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে নোটশিটে লিখেন। পরবর্তীতে নোটাশিটে লেখা বক্তব্যকে পর্যায়ক্রমে রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সমর্থন করেছিলেন। তাঁর ভাষায়: ‘বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে সচিবালয়ে একটি গুজব ছিল যে বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। তাঁর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমি প্রশ্ন তুললাম এবং আমার কিছুই হলো না।’ (পুরানো সেই দিনের কথা, পৃষ্ঠা: ৩৩৮)
ড. আকবর আলি খানের অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিরও আমরা পরিচয় পাই তাঁর বইতে। তিনি লিখেছেন: ‘তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণী এই তিন বছর গুরুচারণ বাবু ছিলেন আমার গৃহশিক্ষক। সন্ধায় তিনি আমাকে পড়াতে আসতেন। আমার সঙ্গে আমাদের পরিবারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সনাতন সাহার ছেলে বজ্রকিশোর সাহাও পড়ত। (ঝড়ের দিনে জন্ম হওয়াতে ওর ডাকনাম ছিল তুফাইন্যা।) আমরা হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ করতাম না। ওর বাবাও হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে কোনো প্রভেদ করতেন না, কিন্তু তুফাইন্যা ভিন্নমত পোষণ করত। শীতকালে যখন তুফাইন্যা আমাদের বাড়িতে পড়তে আসত, তখন তার গায়ে ভাল শীতের কাপড় থাকত না। একদিন খুব ঠান্ডা পড়াতে সে পড়ার সময় শীতে কাঁপছিল। আমি তাকে আমার চাদর এনে পরতে দিই। সে কোনোমতেই সেই চাদর গায়ে দিতে রাজি হয়নি। প্রশ্ন করাতে সে বলে, এই চাদরের গায়ে ‘শেইখ্যা শেইখ্যা’ অর্থাৎ ‘শেখ অথবা মুসলমানের’ গন্ধ করে।’ (পুরানো সেই দিনের কথা, পৃষ্ঠা: ১০৬)।
ড. আকবর আলি খান ছিলেন একজন সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর কিংবদন্তিমূলক সাহসিকতার বহু দৃষ্টান্ত মেলে মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁর অসাধারণ ভূমিকা থেকে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি হবিগঞ্জের মহুকুমা প্রশাসক বা এসডিও ছিলেন এবং যুদ্ধকালীন সক্রিয়ভাবে মুজিবনগর সরকারের সাথে কাজ করেন। অস্থায়ী সরকার গঠিত হওয়ার আগে তিনি নিজ কর্মস্থল হবিগঞ্জে পুলিশের অস্ত্র সাধারণ মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে যুদ্ধ করতে অনুপ্রাণিত করেন, নিজ হাতে তৈরি করেন অস্ত্র উন্মুক্তকরণের সরকারি লিখিত অনুমতি। পাশাপাশি অস্থায়ী সরকারের জন্য তহবিল গড়তে হবিগঞ্জ ন্যাশনাল ব্যাংকের টাকা ট্রাকে করে আগরতলা পৌঁছে দেন। পুরানো সেই দিনের কথা বইতে (পৃষ্ঠা: ২৬৩) তিনি বলেন, ‘আমি অফিস থেকে ন্যাশনাল ব্যাংকের ম্যানেজারকে সেনাবাহিনীর কাছে টাকা দেওয়ার জন্য আদেশ দেই। সেনাবাহিনী ট্রাকে করে ঘণ্টা চারেকের মধ্যে হবিগঞ্জ থেকে এ টাকা আগরতলায় নিয়ে যায়’।
মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তান সরকার তাঁর অনুপস্থিতিতে বিচার করে এবং তাঁকে ১৪ বৎসরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। তবে এসব নিয়ে ড. খানের বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ ছিল না। তাঁর ভাষায়, ‘২৬ মার্চের পর প্রতিদিন ঘুমাতে যাওয়ার আগে নিজেকে প্রশ্ন করতাম বিবেকের বিরুদ্ধে কি কোনো কাজ করেছি, সব সময়ই উত্তর ছিল না। যে সিদ্ধান্তই দিয়েছি এবং যে কাজই করেছি, তা বিবেকের তাড়নাতেই করেছি। আমাদের মনে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে বাংলাদেশ অবশ্যই প্রতিষ্ঠিত হবে।’ (পুরানো সেই দিনের কথা, পৃষ্ঠা ২৬৭)
ড. আকবর আলি খানের মতে, ‘স্বাধীনতা একটা জাতির জন্য সবচেয়ে বড় সম্পদ।’ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য – অন্য কিছুর জন্য নয় – যে স্বাধীনতাকে এথেন্সের ইতিহাসবিদ থুসাইদাইদস সকল সুখের উৎস বলে চিহ্নিত করেছেন। গত ৩ মে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ড. আকবর আলি খান তাঁর নিজের ভাষায় এ কথারই প্রতিধ্বনি করেছিলেন। ‘মুক্তিযুদ্ধে আমরা অত্যন্ত গর্বিত। এ জন্য গর্বিত নয় যে বাংলাদেশ হয়েছে বলে আজ অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি করেছি বা আমাদের লোকজন দেশ শাসন করছে। বরং আমি এ কারণে গর্বিত যে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। স্বাধীনতার চেয়ে বড় অর্জন মনে হয় কিছু হতে পারে না।’ এমন জীবনাদর্শের জন্যই তিনি অনন্য, অন্য বুদ্ধিজীবীদের থেকে আলাদা এবং অনুসরণীয়।
নিজের সময় ও সমাজকে গভীরভাবে পাঠ, বিশ্লেষণ এবং তার ওপর দাঁড়িয়ে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি – এই চর্চা আমাদের দেশে ব্যাপকভাবে হচ্ছে বলে দাবি করার সুযোগ নেই। একজন প্রকৃত বুদ্ধিজীবী হিসেবে সত্য ও কল্যাণের প্রতি নিবেদিত থেকে নিরলসভাবে কাজ করে গিয়েছেন আকবর আলি খান। ব্যক্তিগত কোনো সুবিধার প্রত্যাশা তো নয়ই, বিশেষ কোনো পক্ষ বা মতাদর্শও তাঁকে জ্ঞানগত সততা থেকে বিচ্যুত করেনি। এদিক থেকে দেখলে বুদ্ধিজীবী হিসেবে তিনি এই সমাজে একমাত্র না হলেও বিরল – একথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
সম্প্রতি ড. রওনক জাহান এবং প্রয়াত ড. আকবর আলি খানকে (মরণোত্তর) বিআইডিএস ও বণিকবার্তার পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। আমি এই অনন্য উদ্যোগের জন্য উদ্যোক্তাদেরকে ধন্যবাদ জানাই। আমি একইসঙ্গে এ দু’জন ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে অসাধারণ গুণী মানুষের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন, যে দেশে গুণীজনের সম্মান করা হয় না, সেদেশে গুণীজন জন্মায় না।
মৃত্যুর এক সপ্তাহ আগে ড. আকবর আলি খানের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। সে সময় আমি তাঁকে জানাই যে, তাঁকে সংবর্ধনা জানানো উপলক্ষে আমি তাঁর সম্পর্কে বণিকবার্তায় প্রকাশের জন্য একটি নিবন্ধ লিখেছি। তিনি তখন আমাকে বলেছিলেন যে, তাঁর সম্পর্কে যে নিবন্ধগুলো লেখা হচ্ছে তা হবে তাঁর জন্য শোকবার্তা। তিনি বোধহয় অবচেতন মনেই জানতেন নশ্বর পৃথিবী থেকে তাঁর বিদায় আসন্ন। এ এক সপ্তাহ পরই তিনি আমাদের সবাইকে ছেড়ে পরপারে চলে গেছেন। তিনি চলে গেলেও তাঁর সমৃদ্ধ কর্মজীবনের যে অভিজ্ঞতা তাঁর বক্তব্য ও লেখনীর মাধ্যমে রেখে গেছেন তা আগামীর তরুণ ও আমাদের সকল নাগরিকের জন্য ভবিষ্যতের পথ খুঁজে পেতে সহায়তা করবে বলে আমার বিশ্বাস। আমি ড. আকবর আলি খানের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।