Close

জাতীয় নির্বাচনের জন্য বাতিল ইভিএমে সিটি নির্বাচন কেন

নির্বাচন এক দিনের বিষয় নয়, এটি একটি প্রক্রিয়া এবং এ প্রক্রিয়া কারসাজিমুক্ত হওয়ার ওপর সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নির্ভর করে। যেমন যাঁরা প্রার্থী হতে চান, তাঁরা প্রার্থী হতে পারলেন কি না, প্রার্থীরা নির্বিঘ্নে প্রচার-প্রচারণা চালাতে এবং নির্বাচনী এজেন্ট দিতে পারলেন কি না, ভোটাররা বিনা বাধায় ভোট দিতে পারলেন কি না, নির্বাচনে অর্থ ও পেশিশক্তির প্রভাব নিয়ন্ত্রণে রাখা গেল কি না, ভোট গণনা ঠিকভাবে হলো কি না ইত্যাদির ওপর নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সঠিকতা নির্ভর করে।

পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন আসন্ন। গাজীপুরে ইতিমধ্যে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া ও বাছাই শেষ হয়েছে এবং নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২৫ মে। অন্য চারটির নির্বাচনও জুন মাসের মধ্যে সমাপ্ত হবে।

এসব নির্বাচন সরকার, নির্বাচন কমিশন, এমনকি পুরো জাতির জন্য এক দিকে যেমন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, অন্য দিকে এগুলোকে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করা সংশ্লিষ্টদের জন্য একটি প্রায় অনতিক্রম্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সিটি করপোরেশন স্থানীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে ‘লোকাল ডেমোক্রেসি’ বা স্থানীয় পর্যায়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়, যা গণতন্ত্রের পাটাতনস্বরূপ। তাই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠিত হলে জাতীয়ভাবে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার পথে অন্তত কিছুটা হলেও আমরা এগিয়ে যাব, যা আমাদের গণতান্ত্রিক ভিত মজবুত করার ব্যাপারে ভূমিকা রাখবে।

এ ছাড়া আমাদের সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, একটি স্বায়ত্তশাসিত স্থানীয় সরকারব্যবস্থার মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠা হওয়ার কথা, যাঁরা ‘পাবলিক সার্ভিস’ বা সব জনকল্যাণমূলক সেবা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন-সম্পর্কিত সব পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করবেন।

দুর্ভাগ্যবশত স্থানীয় সরকার-সম্পর্কিত এমন গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক ম্যান্ডেট আমাদের আমলাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষিত।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে অনুষ্ঠিত সব কটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন ছিল তথাকথিত ‘নিয়ন্ত্রিত’ নির্বাচন, যা পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেমন হবে, তার একটি পূর্বাভাস পাওয়া গিয়েছিল। আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করার মাধ্যমে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যে সুষ্ঠু হবে, তার একটি জোরালো বার্তা সরকার দিতে পারে।

তবে এ বার্তার ওপরও দুর্ভাগ্যবশত সর্বদা আস্থা রাখা যায় না। স্মরণ করা যেতে পারে যে ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীরা বিপুল ভোটে পরাজিত হয়েছিলেন, যদিও তাঁদের অনেকেই ছিলেন বিদায়ী মেয়র এবং কেউ কেউ ছিলেন অপেক্ষাকৃত বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন।

এই সব কটি নির্বাচনই ছিল গ্রহণযোগ্য। কারণ, এতে সরকার কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের প্রেক্ষাপটে অনুষ্ঠিত এসব নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার যে বার্তাটি দিতে চেয়েছিল তা হলো, পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু করার ব্যাপারে তাদের ওপর আস্থা রাখা যায়। কিন্তু পরবর্তী দুটি চরম সমালোচিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইতিহাস আমাদের সবারই জানা।

তবে ২০১৩ সালের সিটি নির্বাচনে পর্যুদস্ত হওয়া থেকে প্রাপ্ত বার্তার কারণেই হয়তো সরকারকে তার কৌশল বদলাতে এবং জাতীয় নির্বাচনে জেতার জন্য ‘কারসাজির’ আশ্রয় নিতে হয়েছিল বলে অনেকে মনে করে থাকেন।

আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলো নির্বাচন কমিশনের জন্যও একটি অগ্নিপরীক্ষা। বর্তমান কমিশনের অধীন যেসব নির্বাচন হয়েছিল, তার প্রায় সব কটিই হয়েছিল বিতর্কিত। উদাহরণস্বরূপ, গাইবান্ধা-৫ উপনির্বাচন স্থগিত না বাতিল ছিল, তা নিয়ে নির্বাচন কমিশন একটি গোঁজামিলের আশ্রয় নিয়েছে। স্থগিত হলে, যে ৫১টি কেন্দ্র সিসিটিভি ক্যামেরা ব্যবহার করে কমিশন বাতিল করেছিল, শুধু সেগুলোতেই পরবর্তী সময় পুনর্নির্বাচন হওয়া উচিত ছিল। আর স্থগিত হলে নতুন করে তফসিল ঘোষণা করে অন্যদের প্রার্থী হওয়ার সুযোগ দিয়ে পুনর্নির্বাচনের প্রয়োজন ছিল। আর নির্বাচনে অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত রাঘববোয়ালদের অব্যাহতি দিয়ে শুধু চুনোপুঁটিদের শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে এবং নিজের শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তা না করে কমিশন নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে, যা তাদের আস্থার সংকটকে আরও ঘনীভূত করেছে।

সর্বশেষ চট্টগ্রাম-১২ উপনির্বাচনে গোপন কক্ষে ‘ডাকাতের’ উপদ্রব, কেন্দ্র দখল এবং মাত্র ১৪ দশমিক ৫৫ শতাংশের (২১টি কেন্দ্রে ২-৫ শতাংশের, ৫২টি কেন্দ্রে ৫-১০ শতাংশের) কম ভোটার উপস্থিতি পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশনের ওপর ভোটারদের আস্থাহীনতারই প্রতিফলন। এখন দেখার বিষয়, আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কমিশন এ আস্থার সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবে কি না।

তবে আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহারও কমিশনের আস্থার সংকট কাটানোর ব্যাপারে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে বলে আমাদের আশঙ্কা। ইভিএম কারিগরিভাবে একটি দুর্বল ও কারসাজির যন্ত্র এবং এর ব্যবহারের মাধ্যমে বেড়া নিজেই খেত খেয়ে ফেলতে পারে—এমন অভিযোগ একেবারেই অমূলক নয়। ভোটের ফলাফল বদলিয়ে দিয়ে পরাজিত করার হিরো আলমের অভিযোগ যে সঠিক নয়, তা ফলাফল পুনর্গণনার মাধ্যমে কমিশন প্রমাণ করতে পারেনি; কারণ, ইভিএমে ভোটার ভেরিফায়েবল পেপার অডিট ট্রেইল (ভিভিপিআইটি) না থাকার কারণে তা সম্ভব নয়, যার ফলে কমিশনের প্রদত্ত ফলাফলকেই চূড়ান্ত বলে ধরে নিতে হবে।

প্রসঙ্গত, এ দুর্বলতা কাটাতে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট তাঁদের ব্যবহৃত ইভিএমে ভিভিপিএটি যুক্ত করতে নির্বাচন কমিশনকে বাধ্য করেছেন। এ ছাড়া কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কেন সর্বশেষে প্রাপ্ত চারটি কেন্দ্রের ফলাফল অন্য সব কেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত আগের ফলাফলকে পাল্টে দিল, তার সন্তোষজনক ব্যাখ্যা কমিশন দাঁড় করাতে পারেনি।

তাই এ দুর্বল, বিতর্কিত এবং জাতীয় নির্বাচনের জন্য বাতিলঘোষিত এই যন্ত্র নির্বাচন কমিশন কেন আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ব্যবহারের ঝুঁকি নিল, তা আমাদের বোধগম্য নয়।

যেকোনো নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করার তিনটি পূর্বশর্ত রয়েছে। এগুলো হলো নির্বাচনপ্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও সঠিকতা, নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরপেক্ষতা এবং সংশ্লিষ্ট আইনি কাঠামোর যথার্থতা। নির্বাচন এক দিনের বিষয় নয়, এটি একটি প্রক্রিয়া এবং এ প্রক্রিয়া কারসাজিমুক্ত হওয়ার ওপর সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নির্ভর করে। যেমন যাঁরা প্রার্থী হতে চান, তাঁরা প্রার্থী হতে পারলেন কি না, প্রার্থীরা নির্বিঘ্নে প্রচার-প্রচারণা চালাতে এবং নির্বাচনী এজেন্ট দিতে পারলেন কি না, ভোটাররা বিনা বাধায় ভোট দিতে পারলেন কি না, নির্বাচনে অর্থ ও পেশিশক্তির প্রভাব নিয়ন্ত্রণে রাখা গেল কি না, ভোট গণনা ঠিকভাবে হলো কি না ইত্যাদির ওপর নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সঠিকতা নির্ভর করে।

নির্বাচনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হলো নির্বাচন কমিশন, যার ওপর নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব অর্পিত। সরকার তথা প্রশাসন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান, যা নির্বাচনী ফলাফলকে পাল্টে দিতে পারে। উচ্চ আদালতও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এসব প্রতিষ্ঠানের ‘পক্ষপাতদুষ্টতা’ অতীতের অনেক নির্বাচনকেই ‘বিতর্কিত’ করেছে।

সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আইনি কাঠামোও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেমন প্রয়াত অর্থমন্ত্রী তাঁর জেলায় জেলায় সরকার বইতে জেলা পরিষদ আইনকে একটি ‘অথর্ব’ আইন বলে আখ্যায়িত করেছেন, যা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সহায়ক নয়। দলীয়ভিত্তিক স্থানীয় সরকার নির্বাচনও সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য একটি চরম প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দলীয়ভিত্তিক নির্বাচনের কারণে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এক দিকে যেমন প্রার্থীর সংখ্যা কমে গেছে এবং প্রার্থীর মানে অবনতি ঘটেছে, একই সঙ্গে সরকারি দলের প্রতীকপ্রাপ্ত প্রার্থীদের নির্বাচনে জেতার পথ সুগম হয়েছে।

নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সঠিকতা, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরপেক্ষতা এবং বিদ্যমান আইনি কাঠামো সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করার পথে নিঃসন্দেহে একটি বড় বাধা। অধিকাংশ বিরোধী দলেরই নির্বাচনপ্রক্রিয়া কারসাজিমুক্ত হবে কি না এবং নির্বাচন কমিশন, সরকার, এমনকি উচ্চ আদালতও নিরপেক্ষতা প্রদর্শন করবেন কি না, তা নিয়ে চরমভাবে সন্দিহান। এ কারণে তারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে বিরত থাকছে, যা আসন্ন সিটি করপোরেশনকে গ্রহণযোগ্য করার ব্যাপারে একটি পর্বতপ্রমাণ চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Leave a comment
scroll to top