আগামী দুই মাসের মধ্যে পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। গাজীপুরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২৫ মে। অন্য চারটি খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেটে নির্বাচন জুন মাসের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে অনুষ্ঠিতব্য এ পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে জনমনে কিছু গুরুতর প্রশ্ন দেখা দিয়েছে– এসব নির্বাচন কি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হবে? এগুলোর ফলাফল থেকে আমরা কী বার্তা পেতে পারি? এসব বার্তার ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষত ক্ষমতাসীন দলই বা আগামী জাতীয় নির্বাচনের জন্য কী কৌশল নিতে পারে?
স্মরণ করা যেতে পারে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে অনুষ্ঠিত সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলো ছিল নিয়ন্ত্রিত। মোটাদাগে এসব নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের বৈশিষ্ট্য ছিল– (১) আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করে প্রধান বিরোধী দলের নেতাকর্মীর অনেককে ঘরছাড়া করা, যাতে তারা নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা থেকে দূরে থাকে; (২) নির্বাচনের দিন প্রতিপক্ষের নির্বাচনী এজেন্ট নিয়োগ এবং তাদের দায়িত্ব পালনে বাধা সৃষ্টি করা; (৩) নির্বাচনের দিন পরিকল্পিতভাবে কেন্দ্র দখল করে জাল ভোট দিতে সহায়তা করা; (৪) যেহেতু খুলনা, গাজীপুর, রাজশাহী, সিলেট ও বরিশাল সিটি করপোরেশনে বিএনপি মনোনীত বিদায়ী মেয়ররা মামলা, গ্রেপ্তার, বরখাস্ত ও উন্নয়ন বরাদ্দপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে বৈষম্যের কারণে এলাকায় কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় উন্নয়ন ঘটাতে পারেননি, তাই উন্নয়ন চাইলে সরকারি দল মনোনীত প্রার্থীকেই ভোট দিতে হবে– এমন একটি প্রচারণার মাধ্যমে ভোটারদের সিদ্ধান্তকে অযাচিতভাবে প্রভাবিত করা এবং (৫) এসব অনিয়ম ও বাড়াবাড়ির ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের নির্বিকার ভূমিকা পালন; অনেক ক্ষেত্রে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ।
এ ধরনের নিয়ন্ত্রণ ও পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের প্রভাবে সিলেট ব্যতীত অন্য সব নির্বাচনেই ক্ষমতাসীন দল জয়লাভ করে। সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী সাবেক মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের বিএনপি মনোনীত প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীর কাছে পরাজয় ক্ষমতাসীনদের জন্য পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে তাদের পরাজয়ের আশঙ্কার একটি সুস্পষ্ট বার্তা বহন করে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার প্রয়াত মাহবুব তালুকদারের মতে, ২০১৮ সালের পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন ছিল ক্ষমতাসীনদের জন্য একটি ড্রেস রিহার্সাল এবং এসব নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকেই তারা জাতীয় নির্বাচনের কৌশল নির্ধারণ করে। তাই এটি প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়, পরাজয়ের ঝুঁকি এড়াতেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আরও কঠোর পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার ও ক্ষমতাসীন দল। এ লক্ষ্যেই তারা নির্বাচন কমিশন, সরকারি দল এবং এক শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যোগসাজশে ২০১৮ সালের নির্বাচনে কারসাজির নতুন আয়োজন করে।
এর আগে ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত এই পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফলও একটি সুস্পষ্ট বার্তা বহন করেছিল। এর মধ্যে বরিশাল, খুলনা, রাজশাহী ও সিলেট ছিল আওয়ামী লীগের নির্বাচিত এবং সর্বক্ষেত্রেই অত্যন্ত সফল বিদায়ী মেয়ররা বিএনপি প্রার্থীদের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। নবগঠিত গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ প্রার্থী বিএনপি প্রার্থীর কাছে হেরে গিয়েছিলেন, যদিও গাজীপুরকে আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। এসব নির্বাচনে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথা সরকার কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করেনি, যদিও আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা নির্বাচনে জেতার জন্য নিয়মতান্ত্রিকভাবে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। তবু একটি নির্বাচনেও তাঁরা সফলকাম হতে পারেননি। এসব নির্বাচনে সরকারের পক্ষ থেকে কোনোরূপ হস্তক্ষেপ না করার কারণ ছিল, ২০১১ সালের ৩০ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের প্রেক্ষাপটে দলীয় সরকারের অধীনে পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান ফিরে আসার ফলে সরকার সবাইকে আশস্ত করতে চেয়েছিল– সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তাদের বিশ্বাস করা যায়।
এটি বলার অপেক্ষা রাখে না, ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন থেকে সুস্পষ্ট ও জোরালো বার্তা ছিল– আওয়ামী লীগ তার জনসমর্থন হারিয়েছে এবং সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে তাদের ভরাডুবি হবে। এ কারণেই তৎকালীন স্থানীয় সরকার সচিব আবু আলম মো. শহীদ খানের ভাষায়, ‘তখন আওয়ামী লীগের কৌশল ছিল কীভাবে বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখা যায় এবং তারা বিএনপিকে ফাঁদে ফেলতে সক্ষম হয়’ (‘২০১৮ সালের মতো সিটি নির্বাচন করা সম্ভব হবে না,’ বিশেষ সাক্ষাৎকার, প্রথম আলো, ৩০ এপ্রিল ২০২৩)। পরবর্তী ঘটনা সবারই জানা। সে নির্বাচন বিএনপি বর্জন করে এবং প্রতিহত করার চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
এবারকার সিটি নির্বাচন ঘিরে যে পরিস্থিতি, তা সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিএনপি সব কয়টি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে না বলে এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে এবং গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তারা কোনো প্রার্থী দেয়নি। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন অনুষ্ঠান কিংবা অন্য কোনোভাবে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার কোনো আবশ্যকতা নেই, যদি তারা তাদের বিদ্রোহী প্রার্থীদের পরাস্ত করতে বদ্ধপরিকর না হয়। আর সে আশঙ্কা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
তবে আসন্ন সিটি নির্বাচনগুলো কি তবে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হবে? এসব নির্ভর করবে কতগুলো মানদণ্ড পূরণের ওপর– (১) নির্বাচনে যাঁরা প্রার্থী হতে চান তাঁরা প্রার্থী হতে পারবেন কিনা; (২) ভোটারদের সামনে বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প প্রার্থী থাকবে কিনা; (৩) প্রার্থীরা বিনা বাধায় নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চালাতে এবং নির্বাচনী এজেন্ট দিতে পারবেন কিনা; (৪) যাঁরা ভোট দিতে চান তাঁরা ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে উঠে স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবেন কিনা; (৫) অর্থ কিংবা সহিংসতার মাধ্যমে ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকবে কিনা; (৬) ইভিএম ব্যবহার কারসাজিমুক্ত এবং ভোট গণনা সঠিকভাবে হবে কিনা; (৭) সর্বোপরি ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ, কারসাজিমুক্ত ও বিশ্বাসযোগ্য হবে কিনা।
এসব মানদণ্ড পূরণ হলে নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হবে। এগুলো পূরণের দায়িত্ব মূলত নির্বাচন কমিশন এবং সরকার তথা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। তবে নির্বাচন পরিচালনার মূল দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপর। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বও এ ক্ষেত্রে অপরিসীম। উচ্চ আদালতেরও সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাই এসব প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষতার ওপর আসন্ন নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হবে কিনা তা বহুলাংশে নির্ভর করবে। তবে গাজীপুরের নির্বাচনে জাহাঙ্গীর আলমের প্রার্থিতা রিটার্নিং কর্মকর্তা এবং আপিল কর্মকর্তার বাতিলের প্রেক্ষাপটে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ এসব কর্মকর্তা কমিশনের অধীন।
আমার ধারণা, আসন্ন পাঁচটি সিটি নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলেও এগুলো প্রতিযোগিতামূলক হবে না। কারণ এগুলোতে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে না। আর প্রতিযোগিতামূলক না হলে নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য তথা গ্রহণযোগ্য হয় না। বস্তুত, যে নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক নয়, সেটিকে নির্বাচনই বলা যায় না। কারণ এতে জনগণের সম্মতি অর্জিত হয় না।
‘নির্বাচন’ শব্দের অর্থ ও এর উদ্দেশ্য কী? মেরিয়াম ওয়েবস্টার অভিধান অনুযায়ী, নির্বাচন হলো বেছে নেওয়ার ক্ষমতা, অধিকার ও বিশেষ সুযোগ। তাই যেখানে বিকল্প থাকে না, সেখানে বেছে নেওয়ার সুযোগও থাকে না। ফলে কোনো ভোটের আয়োজনের ক্ষেত্রে যদি বিকল্প প্রার্থী না থাকে, তাহলে সেটিকে নির্বাচন বলা সংগত নয়। আর বিকল্প থাকলেই কি সেখানে বেছে নেওয়ার সুযোগ থাকে? যেমন– এক গ্লাস ট্যাপের পানি আর এক গ্লাস ফোটানো পানি কি একে অপরের বিকল্প? কোনোভাবেই নয়। কারণ এই দুটি বিকল্প সামনে থাকলে এটি নিশ্চিত করেই বলা যায়, একজন ‘র্যাশনাল’ বা যুক্তিশীল তৃষ্ণার্ত ব্যক্তি ফোটানো পানির গ্লাসই বেছে নেবে। তাই পান করার জন্য ফোটানো পানি আর ট্যাপের পানি একে অপরের বিকল্প নয়। পক্ষান্তরে এক গ্লাস ফিল্টারের পানি এক গ্লাস ফোটানো পানির যথার্থ বিকল্প। কারণ উভয়ই নিরাপদ পানি। অর্থাৎ ব্যক্তিকে বাছাই করার ক্ষমতা, অধিকার ও সুযোগ দিতে হলে বিকল্পগুলো সমপর্যায়ের হতে হবে।
অন্যভাবে বলতে গেলে, বিকল্প বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে, যাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ থাকে এবং বিকল্পগুলোর মধ্য থেকে যে কোনোটি বেছে নেওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই নির্বাচনের মাঠে বিএনপি না থাকলে ভোটারদের বিকল্প প্রার্থীর মধ্য থেকে বেছে নেওয়ার সুযোগ থাকবে না। ফলে এ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলেও গ্রহণযোগ্য হবে না এবং জনগণের সম্মতির শাসনও প্রতিষ্ঠিত হবে না।
পরিশেষে, এটি এখনও বলার সময় আসেনি– আসন্ন পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে কিনা। এটি এখনও নিশ্চিতভাবে বলা যায় না, নির্বাচনী ফলাফল কী বার্তা দেবে এবং এ থেকে রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষত ক্ষমতাসীন দল কী কৌশল নেবে। তবে এটি নিশ্চিত করেই বলা যায়, এসব নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না এবং এর মাধ্যমে জনগণের সম্মতির শাসনও অর্জিত হবে না। কারণ এগুলোতে কোনো বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প থাকবে না।