গত ২৮ অক্টোবর এবং তার পরের দিনগুলোর ঘটনাপ্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে যে প্রশ্নগুলো ইতিমধ্যে অসংখ্যবার উচ্চারিত হয়েছে, তা হলো এর পরে কী হবে, দেশের রাজনীতি কোথায় যাচ্ছে।
এ প্রশ্নের সঙ্গে যুক্ত আছে আরও কিছু প্রশ্ন—আগামী দিনগুলোতে সরকার কী করবে; বিরোধী দলগুলো, বিশেষত বিএনপি কোন পথে এগোবে; ২০২৪ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধী দলগুলো যে দাবি নিয়ে আন্দোলন করছিল—একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা, তা আদায়ের পথ আরও কঠিন হয়ে পড়ল কি না।
এ কথা অনস্বীকার্য যে ২০১৮ সালের সাজানো নির্বাচনের পর থেকে কঠোর নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার ওপরে নির্ভরশীল ক্ষমতাসীনেরা গত দেড় বছরে যতটা নমনীয়তা প্রদর্শন করেছে, তার একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে আন্তর্জাতিক সমাজের, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের চাপ। বিদেশিরা যেহেতু বারবার সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন এবং তার পথে অগ্রসর হওয়ার বিষয়ে ‘শান্তিপূর্ণ’ থাকার আহ্বান জানিয়েছে এবং ‘সহিংসতা’কে অগ্রহণযোগ্য বলেছে, সেহেতু এটাও প্রশ্ন যে আন্তর্জাতিক সমাজের অবস্থান কী হবে?
এ প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়ার জন্য ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সংঘটিত ঘটনাগুলোর পূর্বাপর বিবেচনা করা দরকার। গত দেড় বছরে বিএনপির প্রতিটি সমাবেশের আগে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের বক্তব্যগুলোতে যে উত্তেজনা এবং সংঘাতের হুমকি ছিল, সে কথা বিস্মৃত হওয়ার অবকাশ নেই।
গত বছরের আগস্ট মাস থেকে বিএনপির প্রতিটি সমাবেশের সময় ক্ষমতাসীন দল কেবল পাল্টা সমাবেশই আয়োজন করেনি, আইনি নিয়ন্ত্রণ কিংবা নিরাপত্তার নামে পুলিশের অনুমোদনের ক্ষেত্রে যে ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি করা হয়েছে, তারই ধারাবাহিকতা ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করেও করা হয়েছে। ২৮ অক্টোবরের আগেই রাজপথ-অলিগলি দখলে রাখার যে ঘোষণা ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দেন, তা কি সংঘাত ও সহিংসতার পটভূমি তৈরি করেনি? ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর কিংবা ২০১৩ সালের ৫ মের ঘটনার পুনরাবৃত্তির হুমকিকে আর যা-ই হোক শান্তির আহ্বান বলা যাবে না।
কিন্তু এসব সত্ত্বেও গত বছরের আগস্ট মাস থেকে বিএনপি প্রতিটি সমাবেশের ক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণই থেকেছে। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে যে গত বছর ৭ ডিসেম্বর বিএনপি কার্যালয়ের সামনে পুলিশি অভিযান চালিয়ে এই এলাকাকে রণক্ষেত্রে পরিণত করা হয়েছিল, বিএনপির ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশের তিন দিন আগেই এ ঘটনা ঘটে। যে কারণে ২৮ অক্টোবরের পরে প্রশ্ন উঠেছে যে বিএনপি সরকারের পাতা ফাঁদে পা দিয়েছে কি না। এ প্রশ্নের ভেতরে যা প্রায় গ্রহণযোগ্য বলে দাঁড় করানো, তা হচ্ছে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে সহিংসতার উসকানি দেওয়াটা বৈধ এবং বিএনপির সমাবেশে সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটছে সমাবেশে যোগদানকারীদের দ্বারা, ফলে এর দায় কেবল বিএনপির।
এসব কারণে ২৮ তারিখ সংঘটিত ঘটনাবলির দিকে নজর দেওয়া জরুরি। সরকারিভাবে নির্দেশ দিয়ে সমাবেশের আগেই নয়াপল্টন অঞ্চলে ইন্টারনেট সার্ভিস বন্ধ করে দেওয়ার মধ্য দিয়ে তথ্যপ্রবাহ এবং যোগাযোগ বাধাগ্রস্ত করার উদ্দেশ্য নিশ্চয় সমাবেশকে সহযোগিতা করা নয়। এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই যে বিএনপির সমাবেশের আশপাশে বিভিন্ন অলিগলিতে পুলিশের সঙ্গে বিএনপি কর্মীদের বিভিন্ন ধরনের সংঘর্ষ হয়েছে। এগুলোর মাত্রা বিবেচনা করা যেমন জরুরি, তেমনি এটা স্মরণ করা দরকার যে গণমাধ্যমের ভাষ্য অনুযায়ী বিএনপির সমাবেশ সকাল থেকে ছিল উৎসবমুখর।
সমাবেশের আনুষ্ঠানিক সূচনার আগে সমাবেশের দুই দিক থেকে পুলিশের অভিযান চালানো হয়েছে। সমাবেশে মূল বক্তারা তাঁদের বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ পেলে তা যে নেতাদের নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়ত, এমন অনুমান করা ভুল নয়। কারণ, অতীতে বিভিন্ন বিভাগীয় সমাবেশের ক্ষেত্রে, ১০ ডিসেম্বর ২০২২ এবং এই বছরের জুলাই মাসে ঢাকায় একাধিক সমাবেশে সেটাই লক্ষ করা গেছে। কিন্তু ২৮ অক্টোবর পুলিশের আগে থেকেই মারমুখী হয়ে ওঠার মধ্যে সমাবেশ পণ্ড করে দেওয়ার উদ্দেশ্যই কি প্রতিভাত হয় না?
বিএনপি এবং বাংলাদেশের প্রধান দল বলে পরিচিত দলগুলো এমন ধরনের দল নয় যে সব কর্মীর ওপরে দলের নেতৃত্বের পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে এবং তারা চূড়ান্ত শৃঙ্খলার পরিচয় দেবে। ফলে এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই যে বিএনপির কর্মীদের ক্ষুদ্রাংশ আওয়ামী লীগ কর্মী এবং পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছেন এবং সাংবাদিকদের ওপরে চড়াও হয়েছেন। এসব সংঘাতের সময় একজন পুলিশের মৃত্যু ঘটেছে। এগুলো দুঃখজনক এবং নিন্দনীয়; তাঁদের আইনের আওতায় আনার দাবি করা জরুরি।
সংঘাতে পুলিশের, টিয়ার গ্যাসের শেলের আঘাতে সাংবাদিকের, পুলিশের ধাওয়াও বিরোধী দলের কর্মীর এবং ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের পিটুনির কারণে মৃত্যুর ঘটনা অগ্রহণযোগ্য এবং সহিংসতার উদাহরণ। সঙ্গে এটাও মনে রাখা দরকার যে গত বছরের জুলাই থেকে এই বছরে এপ্রিল মাস পর্যন্ত পুলিশ এবং ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের হাতে কমপক্ষে যে ১৫ জন বিএনপি কর্মী মারা গেছেন, সেগুলোও সহিংসতার উদাহরণ।
এগুলোর পরও বিএনপি শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করেছে। সেই আন্দোলনের এই পর্যায়ে এসে তারা কেন এমন সব স্থাপনা আক্রমণ করবে, যেগুলো সহজেই তাঁদের বিরুদ্ধে সহিংসতার উদাহরণ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারবে? কাকরাইলের যে ঘটনা থেকে সংঘর্ষের সূত্রপাত বলা হচ্ছে, সেখানে বিএনপি কর্মীদের ব্যাপক উপস্থিতি জেনে পুলিশ কি আওয়ামী লীগ কর্মীদের বাস-ট্রাকগুলোকে ভিন্ন পথে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে চেষ্টা করেছিল?
ইতিমধ্যেই এটা স্পষ্ট যে সমাবেশ ও পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহকে কেন্দ্র করে সরকার মারমুখী অবস্থান নিয়েছে। কিছুদিন ধরে বিরাজমান রাজনৈতিক সংকটের সমাধানে বিরোধীদের সঙ্গে আলোচনার জন্য দেশের ভেতর ও বাইরে থেকে যে একধরনের চাপ সৃষ্টি হচ্ছিল, তাকে সম্পূর্ণ নাকচ করে দেওয়াই সম্ভবত এর লক্ষ্য। এখন বিএনপি এবং বিরোধীদের রাজপথেই সরকার মোকাবিলার পথে বেছে নিয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনীতি যে আবার সংঘর্ষের পথেই ফিরে এসেছে, তার পথ তৈরি করার জন্যই ২৮ অক্টোবরে সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বিএনপি ও বিরোধী দলগুলোর শান্তিপূর্ণ আন্দোলন সম্ভবত ক্ষমতাসীনদের মধ্যে এই আশঙ্কার জন্ম দিয়েছিল যে এতে বাইরের চাপ এবং জনসমর্থনের কারণেই তাঁদের আপসের পথে অগ্রসর হতে হতো। সেই পথ বন্ধ করে দেওয়া হলো।
ইতিমধ্যেই বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের যে হারে আটক করা হচ্ছে, তাতে সরকারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে উঠছে এবং তা হচ্ছে ক্ষমতাসীন দল এ অবস্থা অব্যাহত রেখেই একটি সাজানো নির্বাচন করতে আগ্রহী। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আচরণ থেকে এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে তারা সম্ভবত এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করতে যাচ্ছে, যাতে বিরোধীরা শুধু নিপীড়নের শিকার হবে তা–ই নয়, তাদের পক্ষে যেন কোনোভাবেই নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগও না থাকে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নির্বাচনের সঙ্গে সংঘাত-সহিংসতার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য—সেই বাস্তবতার কারণে বিরোধী দলগুলো এখন অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, বিষয়টি তা নয়। বরং এ কারণে যে দেশের ভেতরে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন এখন জনগণের আকাঙ্ক্ষায় পরিণত হয়েছে।
নির্বাচনকালে একটি নিরপেক্ষ সরকারের দাবিকে বিরোধী দলের দাবি হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা হলেও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের (আইআরআই) সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে যে দেশের ৬৯ শতাংশ মানুষ মনে করে যে বর্তমান ব্যবস্থার অধীনে অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়; এর মধ্যে ৪৪ শতাংশ মনে করে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা দরকার।
ক্ষমতাসীনেরা আলোচনার টেবিলে বসতে অনাগ্রহী এ কারণে যে তারা এই দাবিকে মোকাবিলা করতে পারবে না। এ রকম পরিস্থিতিতে বিরোধীদের জন্য চ্যালেঞ্জ কেবল তাদের আন্দোলনকে অব্যাহত রাখাই নয়, সেই আন্দোলনে জনসম্পৃক্তি বৃদ্ধি ও নিজেদের মধ্যে একটি বৃহদাকারের ঐক্য গড়ে তোলা। বিএনপির পক্ষ থেকেই এই উদ্যোগ আসা জরুরি। বিএনপি কী করবে, সেই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করছে তাদের কর্মীদের দল কতটা সংগঠিত রাখতে সক্ষম।
এ পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সমাজের প্রতিক্রিয়া কী হবে, তার একটি ইঙ্গিত ইতিমধ্যেই পাওয়া গেছে। বিরোধী দলের বিরুদ্ধে অভিযানের যৌক্তিকতা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের আমন্ত্রণ করে ব্যাখ্যা দিয়েছে। সেই ব্যাখ্যার পর রাষ্ট্রদূতদের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। এতে অনুমান করা যায়, রাষ্ট্রদূতদের অবস্থানে কোনো ধরনের পরিবর্তন ঘটেনি।
প্রথম প্রকাশ : প্রথম আলো, ০১ নভেম্বর ২০২৩