আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে করা প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মূল্যায়নের কথা মনে পড়ছে।
তিনি কী বলেছিলেন এবং কেন সেটা মনে পড়ছে, সেই প্রসঙ্গে আসার আগে প্রেক্ষাপটটা একটু দেখে নেওয়া যাক, যদিও রাজনীতির নিয়মিত পর্যবেক্ষকদের কাছে এটা জানা।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর পোস্টারে ‘আওয়ামী লীগ সমর্থিত’ লেখা নিয়ে তুমুল আলোচনায় মধ্যে অনেকটা হারিয়ে গেছে সাবেক সেনা কর্মকর্তা জেনারেল মাসুদ এবং রুহুল আমিন হাওলাদারের পোস্টারে নিজ দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের ছবির চেয়ে কয়েক গুণ বড় আকারে প্রধানমন্ত্রীর ছবির কথা।
এই ঘটনাগুলো ঘটছে এমন সময়, যখন আমরা জাতীয় পার্টির দিক থেকে সাবালকত্বের আলাপ শুনছিলাম। সাবালকত্বের প্রসঙ্গ এসেছিল সরকারের সঙ্গে সরকারের আসন ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনাকে জাতীয় পার্টির দিক থেকে নাকচ করার জন্য।
আমরা এটাও শুনছিলাম, সরকারবিরোধী ভোট সরকারের ভোটের চেয়ে যেহেতু অনেক বেশি, তাই সুষ্ঠু ভোট হলে ’৯১ সালের মতো ভোটবিপ্লব করে জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় যাবে।
এমনকি রাত-বিরাতে সংবাদমাধ্যমের চোখ এড়িয়ে সরকারি দলের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকের সময়ও আসন ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনার কথা উড়িয়ে দিচ্ছিলেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু।
সংসদে বিরোধী দল হওয়ার ‘খোয়াব’ দেখা দলটি শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আসন সমঝোতা বা সমন্বয় করছে— বিষয়টি খুবই হাস্যকর। ১৭ ডিসেম্বরের পর আমরা দেখলাম ২৬ আসনে ছাড় পেয়েছে জাপা।
অবশ্য সমঝোতা না বলে বলা হলো সমন্বয়। কিন্তু সরকার সমর্থিত অনেক হেভিওয়েট প্রার্থী ও আওয়ামী লীগের ‘স্বতন্ত্র’ বা ‘ডামি’ প্রার্থীদের দাপটে জাতীয় পার্টির ‘ভোট বিপ্লব’ করে ক্ষমতায় যাওয়া দূরে থাক, সংসদে বিরোধী দল হিসেবে নিজেদের অস্তিত্ব ধরে রাখতে পারবে কিনা সেটাই এখন বিরাট প্রশ্ন হিসেবে হাজির হয়েছে।
সাত জানুয়ারি হতে যাওয়া নির্বাচনটিতে বাকি দলগুলোর মধ্যে আছেন ১৪-দলীয় জোটের সদস্যরা এবং নতুন খোলা দুটি দল—তৃণমূল বিএনপি এবং বিএনএম।
দীর্ঘদিন দরবারের পর সরকার তাদের ছয়টি আসনে ছাড় দিলেও আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের দিক থেকে আছেন বড় চ্যালেঞ্জে।
রাজনীতির মাঠে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা বেশ কিছু দলকে ডিঙিয়ে একেবারে নামসর্বস্ব তৃণমূল বিএনপি এবং বিএনএম যখন নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পেল, তখনই এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, এগুলোই হচ্ছে এবারের ‘কিংস পার্টি’।
বিএনপির বড় বড় সব নেতা তাদের সঙ্গে অচিরেই যোগ দেবেন, দল দুটির পক্ষ থেকে বারবার এমন কথা শোনা গেলেও শেষ পর্যন্ত সেটা ‘পর্বতের মূষিক প্রসব’ প্রবচনের আরেকটা উদাহরণ হয়েই থাকল।
এটা এখন স্পষ্ট আগামী ৭ জানুয়ারি যা হতে যাচ্ছে, তা আদতে দেশের ক্ষমতাসীন দলটি সংসদে নিজে কতগুলো আসন রাখবে, নিজ দলের স্বতন্ত্র, ১৪-দলীয় জোটের সদস্য, বিএনএম এবং তৃণমূল বিএনপি এবং সর্বোপরি জাতীয় পার্টিকে কয়টি আসন দেওয়া হবে, সেই ভাগাভাগির আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া আর কিছু নয়।
অর্থাৎ এবারকার নির্বাচনে এমন একটি দলও নেই, যেটি সত্যিকার অর্থে সরকারের ক্ষমতায় থাকাকে তাত্ত্বিকভাবে হলেও চ্যালেঞ্জ করে। গণতন্ত্রের খুব প্রাথমিক জ্ঞান থাকা মানুষও বোঝে অন্তত তাত্ত্বিকভাবেও সরকারের ক্ষমতায় থাকাকে যে দলগুলো চ্যালেঞ্জ করে না, তারা আর যা-ই হোক, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিরোধী দল নয়।
এ পর্যায়ে আমরা একটু দেখে আসি চীনের রাজনৈতিক ব্যবস্থার কয়েকটি মৌলিক বিষয়। আমরা নিশ্চয়ই জানি বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণকল্পে গণতন্ত্র সম্মেলন আয়োজন করেছেন।
প্রথম সম্মেলনটিকে সামনে রেখে সবচেয়ে মজার যে ঘটনাটি ঘটিয়েছে চীন, সেটা হচ্ছে গণতন্ত্র নিয়ে চীন নিজেই প্রকাশ করেছে একটি শ্বেতপত্র।
‘চায়না: ডেমোক্রেসি দ্যাট ওয়ার্কস’ শিরোনামের মোটামুটি দীর্ঘ একটি লেখায় চীন নানাভাবে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে চীন একটি অসাধারণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র।
এই দলিলে আলোচনা আছে চীনের আইন পরিষদ, অর্থাৎ ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেস (এনপিসি) কীভাবে আইন পাস করে। আমাদের জানানো হয়েছে, সেখানে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি একমাত্র দল নয়, আছে আরও আটটি দল।
সেখানে আছে একেবারে স্বতন্ত্র সদস্যও। বর্তমানে ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসের ২৯৮০ আসনের মধ্যে ২১০০-এর কিছু বেশি আছে সি চিন পিংয়ের নেতৃত্বাধীন চীনা কমিউনিস্ট পার্টির হাতে।
বাকি আসন আছে সেই আটটি ‘বিরোধী’ দল এবং স্বতন্ত্র ব্যক্তির হাতে। তাই সেখানে নাকি খুবই আলাপ-আলোচনার সুযোগ আছে।
সেই শ্বেতপত্র আমাদের জানায়, তাদের আছে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত চায়নিজ পিপলস ন্যাশনাল কনসালট্যাটিভ কনফারেন্স (সিপিপিসিসি), যেখানে পার্টির সদস্য ছাড়াও আছেন রাষ্ট্রের নানা ‘স্বাধীন’ থিঙ্কট্যাংক এবং বিশেষজ্ঞরা।
বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী-অধ্যুষিত অঞ্চলে স্বায়ত্তশাসনের কথা বলা আছে, আছে গ্রাম পর্যায়ে নাগরিকদের প্রতিনিধি ‘নির্বাচন’ করার ক্ষমতার কথা।
জনগণের অভাব-অভিযোগ-ক্ষোভের কথা ক্ষমতাসীন পার্টি তার চ্যানেলে বের করে নিয়ে আসে। একই সঙ্গে জনগণ তাদের স্থানীয় প্রতিনিধির কাছে তাদের সমস্যার কথা জানাতে পারে এবং তার মাধ্যমে ধাপে ধাপে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে।
এ ছাড়া জনগণ তাদের নানা সামাজিক মাধ্যমে তাদের অভিযোগ জানাতে পারে। এভাবেই তারা একটি ‘কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা’ নিশ্চিত করেছে।
এই শ্বেতপত্রে গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি নির্বাচনী ব্যবস্থাকে তুলাধোনা করার চেষ্টা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এই ব্যবস্থায় নির্বাচনের সময় অনেক গান-নাচ হয়, কিন্তু নির্বাচনের পর সরকার তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে না বলে এই ব্যবস্থা অর্থহীন।
এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্য হচ্ছে চীনের সংসদের অন্য দলগুলো ‘বিরোধী দল’ হলেও তারা চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব মেনে কাজ করে।
অর্থাৎ তারা সরকারের কিছু ‘সমালোচনা’ করলেও সেটা কখনো কোনোভাবেই চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষমতায় থাকাকে চ্যালেঞ্জ করা দূরে থাকুক, ন্যূনতম প্রশ্নের মুখেও ফেলে না। আমাদের দেশে এটাকেই সম্ভবত আমরা বলি ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দল।
দ্বাদশ সংসদ গঠিত হলে সেটার দলগুলোর সংখ্যা এবং ধরন যা দাঁড়াচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে বাংলাদেশে অনেকটা চীনা মডেল বাস্তবায়নের কাজ হচ্ছে।
এর সঙ্গে যদি ২৮ অক্টোবরের পর থেকে বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন দমন-পীড়নের মাধ্যমে বিএনপিকে নির্বাচনে থাকার ন্যূনতম সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করার চেষ্টার বিষয়টিকে যুক্ত করি, তাহলে এটা স্পষ্ট, এই মডেলটি একেবারেই সুপরিকল্পিত।
আরও এক বা দুই দফা ক্ষমতায় থাকতে পারলেই বিএনপি দল হিসেবে আর এতটা ঐক্যবদ্ধ এবং শক্তিশালী টিকে থাকতে পারবে না, তাই এই মডেলে চালিয়ে যেতেও সরকারের ন্যূনতম কোনো সমস্যা হবে না, এমন একটা বিশ্বাস বোধ করি ক্ষমতাসীন দলের আছে।
চীনের ‘চায়না: ডেমোক্রেসি দ্যাট ওয়ার্কস’ শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, কারও নির্ধারিত মানদণ্ডের সঙ্গে তুলনা করে অন্য দেশের গণতন্ত্র আছে, নাকি নেই, সেটা নির্ধারিত হতে পারে না।
পৃথিবীর ভূপ্রকৃতি এবং জাতিগত ভিন্নতা মেনে নিয়ে গণতন্ত্রের ধরন নির্ধারণ করতে হবে। এসব বলে চীন নিজেকে গণতান্ত্রিক প্রমাণ করতে এতটা মরিয়া হয়েছে যে তারা বলেছে, প্রয়োজনে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা পাল্টাতে হবে।
টাইম ম্যাগাজিনে প্রধানমন্ত্রীর গণতন্ত্র নিয়ে মূল্যায়ন আসলে মনে পড়েছিল চীনের শ্বেতপত্রে গণতন্ত্র সম্পর্কে এই বক্তব্যের কারণে।
ম্যাগাজিনটি তাদের প্রতিবেদনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার যখন নিয়েছিল, সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দেশে দেশে ভিন্ন হয়’।
দেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক মডেল যে অনেকটাই পরিকল্পিত, তার আরেকটি প্রমাণ দেখা গেল সম্প্রতি।
প্রধানমন্ত্রীর দেশে দেশে গণতন্ত্রের সংজ্ঞার ভিন্নতার তত্ত্বকে আরও ব্যাখ্যা দিয়ে সম্প্রতি ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘নতুন একটা স্ট্র্যাটেজিতে আমরা বাংলাদেশের ওয়েস্টমিনস্টার টাইপের ডেমোক্রেসি করতে চাচ্ছি। একটা নতুন এক্সপেরিয়েন্স নিতে যাচ্ছি। বিশ্বকেও দেখাতে চাচ্ছি, জনমত নিয়ে এটিও ডেমোক্রেসি।’ (সারাবাংলা, ২৬ ডিসেম্বর)
চীনের সঙ্গে একটাই পার্থক্য আছে আওয়ামী লীগের মডেলে—বাংলাদেশে এখনো কাগজে-কলাম দেশের সব নাগরিকের ভোটাধিকার আছে এবং তারা ভোট প্রদানের মাধ্যমে তাদের সরকার নির্বাচিত করার ক্ষমতা রাখে। চীনে সব নাগরিকের হাতে এই ক্ষমতা নেই; আছে শুধু পার্টির হাতে।
কে না বোঝে সাংবিধানিকভাবে একদলীয় রাষ্ট্রের তকমা গায়ে লাগানোর চেয়ে দেশের বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে সাংবিধানিক এবং আইনগতভাবে কাগজে রেখে নিজেদের শাসন অব্যাহত রাখার কৌশল এর ঢের ভালো।
আনুষ্ঠানিক একদলীয় ব্যবস্থার বদনাম না নিয়ে এর সুফল ষোলো আনা নেওয়া দুর্দান্ত স্মার্ট সিদ্ধান্ত তো বটেই।
প্রথম প্রকাশ : প্রথম আলো, ০৫ জানুয়ারি ২০২৪