যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর আলী রিয়াজের মতে, ‘তিন কারণে ভারত বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। প্রথমত, বৈশ্বিক শক্তি হওয়ার রাজনৈতিক অভিলাষ এবং ভূ-কৌশলগত নিরাপত্তা। দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক স্বার্থ। তৃতীয়ত, বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবকে সীমিত রাখা।’ এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, ‘ভারত গোটা দক্ষিণ এশিয়াকে তার উঠান বলে বিবেচনা করে। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার সময় থেকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ভারত ভৌগোলিকভাবে তার সীমানা বৃদ্ধি করতে চেয়েছে। তাদের নীতিনির্ধারকদের বিবেচনায় ভারত এমন একটা এলাকায় আছে যেখানে তার চারপাশের দেশগুলো তার প্রতি শত্রু ভাবাপন্ন।’ (ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজের ‘বাংলাদেশ ও তার প্রতিবেশী: বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব’ শীর্ষক ওয়েবিনার, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪)।
বর্তমানে আমরা ফিলিস্তিনে ইজরাইলি এবং ইউক্রেনে রাশিয়ান আগ্রাসন পরবর্তী এক অমানবিক সময়ে বসবাস করছিÑযখন বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক পরাশক্তিগুলোর কাছে ছোট ও দুর্বল প্রতিবেশী দেশ স্বাধীন সত্তা, সমমর্যাদা, সার্বভৌমত্ব নিয়ে বাঁচার অধিকার সংকুচিত হওয়ার বিরাট আশঙ্কা তৈরি হয়েছে এবং বিশ্বের দেশে দেশে গণতন্ত্র ক্ষয়িষ্ণু হয়ে কর্তৃত্ববাদী শাসক ও স্বৈরশাসকদের নতুন এক বলয়ের উত্থান ঘটছে। বাংলাদেশ এই দুটি ফেনোমেনন থেকে বিচ্ছিন্ন নয় কোনোভাবেই।
বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে শক্তিশালী বলে বলা হলেও, বাংলাদেশে খোদ ভারতেরই যারা বন্ধু আছেন, যারা বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার সম্পর্ককে ন্যায্যতা ও সমমর্যাদার ভিত্তিতে দেখতে চান, ইকুইটেবল এবং উইন দেখতে চান তারাও গণতান্ত্রিক অবক্ষয়ের এই সময়ে ভারত নিয়ে কথা বলতে বেশ বিব্রত বোধ করেন। প্রশংসামূলক কথার বাইরে গিয়ে বাস্তবধর্মী কথা বলা এই সময়ে বেশ স্পর্শকাতর।
এক.
মূলত ২০১৩ সালের পরের এক দশকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা নির্ধারণে ভারত এককভাবে সবচেয়ে বড় পক্ষে হয়ে উঠেছে। এসময়ে বাংলাদেশের মানুষ একাধিক এক দলীয় নির্বাচন, রাতের ভোটের নির্বাচন এবং ডামি প্রার্থীর নির্বাচন প্রত্যক্ষ করেছে। সাক্ষাৎভাবে এদেশের মানুষ ভোটাধিকার হারিয়েছে এবং নির্বাচনের নামে প্রতারিত হয়েছে। দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো এ সময় অত্যন্ত দুর্বল হয়েছে। রাজনৈতিকবিরোধী এবং ভিন্নমতের বিরুদ্ধে বিচারালয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ওয়েপনাইজড করা হয়েছে। এ সময়ে দেশে অর্থনৈতিক বিকাশের নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকঋণ লুটপাট ও পাচারের অরাজকতা বেড়েছে, ভয়ের সংস্কৃতির বিস্তার ঘটেছে। ভিন্নমত ও বিরোধী রাজনীতির নেতাকর্মীদের ওপর মামলা ও জেল অতীতের সব রেকর্ড বহুগুণে ছাড়িয়েছে।
এই কাজগুলো দৃশ্যমানভাবে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ করলেও বাংলাদেশের সচেতন মানুষের একটি বড় অংশ করে, এর পেছনে ভারত আছে। দেশে বুদ্ধিবৃত্তিক শুধু নয়; বরং রাজনৈতিক অঙ্গনেও ভারতের প্রত্যক্ষ সমর্থনকেই দায়ী করা হয় সচরাচর। খোদ সরকারের দ্বিতীয় শীর্ষ মন্ত্রী বলেন. ‘দিল্লি আছে, আমরা আছি।’ অর্থাৎ বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের অপকর্মের বদনাম বয়ে বেড়াচ্ছে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত, এই এক অদ্ভুত সত্য, ‘বিগ এলিফ্যান্ট ইন দ্য হাউজ’। বিষয়টি নতুন নয়। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে, ফারাক্কায় গঙ্গা ব্যারাজ চালুর সময়ে, ১৯৭৫ সালের বাকশালের প্রবর্তনেও বাংলাদেশের মানুষ ভারতকে দুষেছে। বর্তমানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বন্ধের পাশাপাশি অনিয়মিত বিরতিতে চলতে থাকে সীমান্তে নিরীহ মানুষ হত্যা বাংলাদেশে ভারত বিরোধিতার প্রমোশনের একটা স্থায়ী প্রক্রিয়া।
দুই.
সম্প্রতি বাংলাদেশে ভারতের পণ্য বয়কটের মতো ডাক উঠেছে। মালদ্বীপের অনুকরণে ইন্ডিয়া আউট নামক সোশ্যাল মিডিয়া ক্যাম্পেইন চলছে। এটা ঠিক যে, বাণিজ্যের আমদানি ও রপ্তানি গন্তব্য বহু বছর এবং বহু অনুঘটকের মিথস্ক্রিয়ার পরে একটা শেইপ পায়, এটাকে রাতারাতি পরিবর্তন করে দেয়া যায় না। ভোক্তা নয় শুধু, ব্যবসায়ীরা চাইলেই ইমপোর্ট সাবস্টিটিউশান তাৎক্ষণিকভাবে তৈরি করতে পারে না। কঞ্জিউমার মার্কেটের বিকাশে ভোক্তার কমফোর্টগত দিক, পণ্যের গুণগত মানের বিষয় আছে। আজকের ভোগবাদী বস্তুবাদী মুক্তবাজার অর্থনীতি পরিচালিত সমাজে কঞ্জিউমার মার্কেটে দেশপ্রেমের আলাপ অর্থহীন, বাস্তবতা হচ্ছে প্রাইস ও কোয়ালিটি মিক্স। স্বদেশী পণ্য তখনই যায়গা করে নিতে পারে যখন সে প্রাইস কম্পিটিভিনেস ধরে রেখে পরিমিত কোয়ালিটির নিশ্চয়তা দিতে পারে। তাই আমরা দেখি, পণ্য বয়কটের রাজনীতিকরণ সাময়িক কাজ করে, দীর্ঘমেয়াদী করে না। এখানে বয়কট মুখের স্লোগান হলেও, মূল বিষয় হচ্ছে গণতান্ত্রিক অধিকার চুরি হয়ে যাওয়া দেশে ভারতের বিরুদ্ধে নাগরিকের জমে ওঠা ক্ষোভ!
২০১১-১২ অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারত থেকে ৪৭৪ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছিল। এর পরের ১০ বছরে আমদানি বেড়েই চলেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে এসে ভারত থেকে আমদানির পরিমাণ দাঁড়ায় ১ হাজার ৩৬৯ কোটি ডলারে। (সূত্র: ‘ঋণ আর বাণিজ্যে এখন বড় অংশীদার ভারত’, ২৩ নভেম্বর ২০২৩)। ড. আলী রীয়াজ বলেছেন, ‘কার্যত বাংলাদেশ ভারতের একটি ক্যাপটিভ মার্কেটে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের আমদানি কাঠামো এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের জন্য ভারতের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।’ (সূত্র : ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ)। করোনার সময়ে আন্তর্জাতিক সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়লে অরগ্যানিকভাবেই ভারত থেকে বাংলাদেশের আমদানি বাড়ে যায়। স্বল্প সময়ে এলসি খোলা, সহজ ট্রান্সপোর্টেশন, সমুদ্রপথের বদলে দ্রুততম স্থলপথের ব্যবহার এবং পেরিশেবল (পচনশীল) পণ্যের মজুদের বড় বিনিয়োগ না করা আমদানি পলিসি ভারতকে ক্রমবর্ধমান খাদ্য জ্বালানি ও কাঁচামাল আমদানির সুবিধা দিয়েছে। এর সঙ্গে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকার সম্পর্ক সীমিত। সরাসরি সীমান্তের বাণিজ্য সুফল আছে বলে, ব্যবসায়ীরা হুট করেই জরুরি পণ্যের কিংবা কাঁচামাল ও খাদ্য পণ্যের ভারত-নির্ভর আমদানি বন্ধ করতে পারবেন। তাদের নতুন কম্পিটিটিভ বাজার কিংবা দেশীয় উৎপাদনের নিশ্চয়তা দিতে হবে আগে।
তথাপি চিন্তার বিষয় হচ্ছে, যেকোনো সংকটে বর্ধিত বাণিজ্য বৈষম্য সাস্টেইনেবল না, আমদানি বহুমুখীকরণ না থাকা রাজনৈতিক কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঝুঁকিপূর্ণ। উপরন্তু এটা ডলার সংকট ত্বরান্বিত করছে, কেননা বাংলাদেশের ৪০% বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসে থাকলেও ভারতের চাপে আদানি থেকে বছরে ১.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অপ্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ আমদানির অন্যায় এবং চাপিয়ে দেয়া বিষয়ও এখানে আছে। এক দশকে ভারত থেকে আমদানি তিন গুণ বেড়েছেÑএকক উৎসে এভাবে আমদানিনির্ভর হয়ে পড়াকে সাস্টেইনেবল বলা চলে না। তবে ‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইনে দীর্ঘমেয়াদী বাংলাদেশের কর্পোরেট খাতে ভারতের ‘সফটওয়্যার এবং সার্ভিস বেজড বিজনেস’ মার্কেটের ওপর কিছু প্রভাব পড়তে পারে এবং বিশেষ করে বাংলাদেশে কর্মরত এক্সপার্ট ভারতীয়দের মানুষিক যন্ত্রণার কারণ তৈরি হতে পারে, কিংবা কিছু ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বিঘ্নেরও কারণ হতে পারে।
তিন.
সব ছাড়িয়ে, সমালোচকদের মতে ভারতীয় পণ্য বয়কটকে ‘ত্রুটিপূর্ণ ডামি নির্বাচনের আলাপ শতভাগ সরিয়ে দিয়ে, সোশ্যাল মিডিয়া ডিসকাশন পয়েন্ট পরিবর্তন করে শেখ হাসিনা সরকারকে কমফোর্ট দেয়ার ষড়যন্ত্র’ হিসেবেও দেখা হচ্ছে। এর জঘন্যতম আরেকটি উদ্দেশ্য হতে পারে, বাংলাদেশের বিরোধীদের সঙ্গে ভারতের একটি দীর্ঘস্থায়ী তিক্ততা তৈরি করা, যা ক্ষমতাসীনদের পর্যাপ্ত সুবিধা দিবে দীর্ঘমেয়াদী। ফলে সরকারকে ‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইনে চিন্তিত দেখা যাচ্ছে না। উপরন্তু বর্তমান ডলার সংকটের সময়ে তাদের কেউ কেউ ভাবছেন, কিছু আমদানি কমে কিছু ডলার সাশ্রয় হলে ক্ষতি কী!
চার.
নেপাল ও মালদ্বীপের উদাহরণ সামনে রেখে এই সত্যে উপনীত হওয়া যায় যে, ভোটাধিকারসহ গণতান্ত্রিক, অর্থনৈতিক এবং পানির অধিকারহীনতার প্রশ্নে বাংলাদেশের বিশালসংখ্যক মানুষকে হোস্টাইল রেখে-ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক দীর্ঘমেয়াদী টেকসই হবে না। ভারতের কথিত ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতির মধ্যে প্রতিবেশীর স্বার্থ রক্ষার উইন-উইন চুক্তি কিংবা বাণিজ্যিক ন্যায্যতা দেখা যায় না। বরং পশ্চাতে দেখা যাচ্ছে-ক। চিন ও যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে অধিক পরিমাণে ক্ষমতা বিস্তারের রাজনীতি, ভূরাজনৈতিক কৌশলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, খ। ভারতের দিকে হেলে থাকা একপাক্ষিক কানেক্টিভিটির নিশ্চয়তা তৈরি এবং গ। ভারতের রপ্তানি বাণিজ্য প্রসার এই তিন ডোমেইনে একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার বিদ্যুৎ বন্দর ট্রানশিপমেন্ট ট্রানজিট এবং করিডোর সংক্রান্ত উল্লেখযোগ্য বেশকিছু চুক্তি উভয় দেশের জন্য উইন-উইন নয় বলে, বাংলাদেশের স্বার্থ সুরক্ষার প্রশ্নে এসব চুক্তির বাস্তবায়ন ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। অতীতে উইন-উইন ছিল না বলে নৌ প্রটোকল বা নৌ ট্রানজিট কাজ করেনি। দেখা গেছেÑভারতের বাঁধের কারণে, পানিশূন্যতার কারণে নৌরুটের নাব্যতা নেই, অন্যদিকে অর্থ ও প্রযুক্তির অভাবে আন্তর্জাতিক নদীতে ড্রেজিংয়ের বন্দোবস্ত নেই। বর্তমানেও বাংলাদেশের পক্ষে বিদেশি ঋণ নিয়ে খরুচে সড়ক-রেল-সেতু ইত্যাদি তৈরি করে ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্ট কিংবা করিডরের চুক্তিগুলো নামমাত্র শুল্কে এগিয়ে নেয়া অসম্ভব। দরকার যৌক্তিক টোল ফি ও শুল্ক আদায়ের ইকুইটেবল একটা ফ্রেমওয়ার্ক। নচেৎ কানেক্টিভটি এই যুগে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতের প্রাপ্ত কানেক্টিভটি সুবিধাগুলোর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হবে। কানেক্টিভটি বাণিজ্য-নির্ভর হবে না হবে সামরিক চাহিদা নির্ভর হবে। এসব অযৌক্তিক কস্ট মডেলের কারণেই আমারা দেখি, ট্রানজিট নিয়ে আলোচনা বেশি, অগ্রগতি কম। বিষয়টা দুর্বল সরকারকে চাপ দিয়ে ট্রানজিট আদায়ের যতটা যা তার চেয়ে বেশি অর্থনৈতিক সাসটেইনেবিলিটির।
পাঁচ.
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার দীর্ঘমেয়াদি সুসম্পর্কের অতীত ভরকেন্দ্র হলো ‘আন্তর্জাতিক নদীর পানির হিস্যা’। তিস্তা চুক্তির একটি ন্যায্য পরিণতি নিশ্চিত করতে পারেনি ভারত। এটা বাংলাদেশের মানুষের যারা ভারতের প্রকৃত বন্ধু তাদের মনেও ক্ষত তৈরি করেছে। তারা দেখেছেন, তিস্তা হয়নি অথচ আদানি সশরীরে গণভবনে এসে বিদ্যুৎ চুক্তির বিলে শেখ হাসিনার স্বাক্ষর আদায় করে গেছেন। এসব ফেলে দেয়ার বিষয় নয়, বরং মানুষের মনে দাগ কেটেছে।
বাংলাদেশের স্বাদু পানির বড় উৎস যমুনা ব্রহ্মপুত্র। জলবিদ্যুতের জন্য ডজন ডজন ড্যাম ও জলাধার নির্মাণ করে কিংবা আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের জন্য পানি প্রত্যাহার করে যমুনার পানি প্রবাহে সংকোচন করে ফেলে বাংলাদেশের গ্রীষ্মকালে মরুকরণে পড়ে পরিবেশ এবং কৃষির সীমাহীন ক্ষতি হবে। এমতাবস্থায় যমুনার প্রবাহকে ধারাবাহিক রাখা এবং ২০২৬ সালে গঙ্গা পানি চুক্তির স্বতঃস্ফূর্ত নবায়ন বাংলাদেশের জন্য বড় বিষয়। বিষয়টি দুদেশের সম্পর্ক পিপল-টু-পিপল করার বড় অনুঘটক।
ছয়.
বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের নতুন সূত্র রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন। বাংলাদেশের মানুষের মন জয় করতে চাইলে ভারতকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে দৃশ্যমান সহযোগিতা করতে হবে। ভারত এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গা প্রশ্নে জাতিসংঘের ভোটাভুটিতে হয় মিয়ানমারের পক্ষে ভোট দিয়েছে অথবা নিরপেক্ষ থেকেছে, বাংলাদেশের পক্ষে একবারও দাঁড়ায়নি। মিয়ানমার সীমান্তে বিদ্রোহীদের উত্থান, আরাকান আর্মির সঙ্গে ভারতের বৈরিতা এবং সীমান্তে নিরাপত্তা প্রশ্নে বাংলাদেশ ও ভারতের স্বার্থ তখনই অভিন্ন হবে, যখন ভারত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কার্যকর উদ্যোগ নেবে।
ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক এমন হওয়া চাইÑযেখানে বৃহৎ প্রতিবেশী এবং আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ভারতের নিরাপত্তাগত সংকট সমাধানে এগিয়ে আসবে বাংলাদেশ, যেটা গত একদশকে দেশটি নিশ্চিত করেছে সত্যিকারভাবে। তেমনি ভারতও বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে সম্মান করে এখানে প্রকৃত গণতান্ত্রিক বিকাশ এবং সক্ষম প্রতিষ্ঠান তৈরির পথে বাধা থেকে নিজের সংশ্লিষ্টতা উঠিয়ে নেবে শতভাগ। বাংলাদেশের একদলীয় সরকারের সমর্থনের বদলে ভারতের উচিত হবে বাংলাদেশের মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী সবগুলো দলের সঙ্গে কাজের সূত্র ও সম্পর্কের ক্ষেত্র তৈরি করা এবং বিষয়টিকে শুধু মৌখিক না রেখে বরং দৃশ্যমান করে একটি দলের পরিবর্তে বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক সম্প্রসারণের একটা বড় উদ্যোগ নেয়া। ভারতের এমন কাজগুলো কন্টিনিউ করা উচিত হবে না যেখানে বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ ও বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গন এই উপসংহারে পৌঁছে যায় যে, বাংলাদেশ গণতন্ত্র ও সীমান্ত প্রশ্নে নিজের স্ট্র্যাটেজিক সিদ্ধান্ত নেয়ার সার্বভৌমত্ব হারিয়ে ফেলেছে। সেটা হলে, ভারত ও বাংলাদেশের মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ও শত্রুতা বাড়বেই, যার প্রভাব দীর্ঘমেয়াদী খারাপই হবে।
ভারত ও বাংলাদেশের সামনে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিন্ন চ্যালেঞ্জ আছে, আন্তর্জাতিক নদীর পানি বণ্টন, নদী ও সমুদ্রের পানি ও দূষণ প্রতিরোধ, বন্যা মোকাবিলায় প্রযুক্তির সর্বোচ্চ প্রয়োগ এবং সর্বোপরি কৃষি, প্রাণ প্রকৃতি ও পরিবেশ তথা বায়ো-ডায়ভার্সিটি সুরক্ষার অভিন্ন চ্যালেঞ্জ সমূহ রয়েছে। এসব বাদ দিয়ে আমাদের সম্পর্কের সব ফোকাস আটকে আছে ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনে, আন্ডার ও ওভার টেবিল নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে একটি বিশেষ দলকে অবৈধভাবে ক্ষমতায় রাখার ওপর। এই অবস্থান থেকে সরে আসাটাই উভয় দেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদী মঙ্গল।
বলা হয় নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা প্রশ্নে ভারত বাংলাদেশের একদলীয় ব্যবস্থাকে সমর্থন দিচ্ছে, আন্তর্জাতিক শিষ্টতা কিংবা নৈতিক দিক থেকে এটা অগ্রহণযোগ্য। এটা করা হচ্ছে গণতন্ত্রের মূল্য চুকিয়ে। বাংলাদেশের মানুষ মনে করছে, ভারত বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে সম্মান করছে না, তাদের ভোটাধিকার ও রাজনৈতিক অধিকার বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভারত। বিপুলসংখ্যক মানুষকে দীর্ঘমেয়াদী অধিকার বঞ্চিত করা ভারতের নীতি বাংলাদেশে স্থিতিশীলতার নিশ্চয়তা দিবে না ভবিষ্যতে, বরং গভীরতর অপ্রত্যাশিত ঝুঁকি তৈরি করবে।
প্রথম প্রকাশ : শেয়ার বিজ নিউজ, ১৪ মার্চ ২০২৪