শ্রমবাজারে বাংলাদেশ একটি উদ্বেগজনক সংকটের মুখোমুখি। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার জিডিপি এবং বেসরকারি বিনিয়োগের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে। ৫০ বছরের নীতিগত প্রচেষ্টার পরেও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ শ্রমবাজার এখনো অপরিপক্ব এবং প্রধানত তৈরি পোশাক খাতের ওপর নির্ভরশীল। রপ্তানিভিত্তিক হওয়া সত্ত্বেও এই খাত উচ্চ দক্ষ এবং উচ্চ মজুরির কর্মসংস্থান তৈরিতে সক্ষম হয়নি। পাশাপাশি নন-আরএমজি রপ্তানি খাতের সম্প্রসারণ বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) হ্রাসের কারণে বাধাগ্রস্ত হয়েছে এবং শিল্প ও উৎপাদন খাত স্থবির হয়ে পড়েছে।
কর্মহীন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি বাড়ছে যুব বেকারত্ব সমস্যা। তরুণদের একটি ক্রমবর্ধমান অংশ কর্মসংস্থান, শিক্ষা বা প্রশিক্ষণে নেই। দীর্ঘমেয়াদি বেকারদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারীদের সংখ্যাও বাড়ছে। এই প্রবণতাগুলো দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নিয়ে সমাজজুড়ে হতাশা ও উদ্বেগ সৃষ্টি করছে। শিক্ষাব্যবস্থার ফাঁকফোকরের কারণে বর্তমান কর্মসংস্থান সংকট আরও গভীর হচ্ছে।
প্রতিবছর শ্রমবাজারে প্রবেশকারী ২০ লাখের বেশি তরুণের জন্য কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের পাশাপাশি তাৎক্ষণিক ভিত্তিতে স্মার্ট কর্মসংস্থান ও দক্ষতানীতির প্রয়োজন। এতে বাংলাদেশের ‘জনসংখ্যাগত সম্পদ’ (১৫-২৯ বছর বয়সী তরুণ–তরুণী) যেন ‘জনসংখ্যাগত দায়’ না হয়ে ওঠে।
এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য চাকরি সৃষ্টির গতি ত্বরান্বিত করা, কাজের মান উন্নত করা, নতুন কর্মীদের ক্ষমতায়ন এবং চাকরিপ্রার্থীদের উপযুক্ত কর্মসংস্থানের সুযোগের সঙ্গে সংযুক্ত করার পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। এ জন্য ১০ দফা নীতিমালা বা কর্মসূচি গ্রহণ অপরিহার্য।
১. ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং নন-আরএমজি খাতে মজুরিভিত্তিক কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা: আমাদের কৃষি, বিশেষ করে কৃষি প্রক্রিয়াকরণ এবং কৃষিপ্রযুক্তি একটি প্রতিশ্রুতিশীল ক্ষেত্র। কৃষি এখনো মোট কর্মসংস্থানের প্রায় দুই-পঞ্চমাংশ, তবু বেশির ভাগ কাজ কম উৎপাদনশীল ও অনানুষ্ঠানিক। খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, প্যাকেজিং এবং বিতরণের মতো মূল্য সংযোজন কার্যক্রমের প্রচারের মাধ্যমে বাংলাদেশ আরও আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে এবং গ্রামীণ আয় বাড়াতে পারে।
২. শিল্প প্রবৃদ্ধি বহুমুখীকরণ ও সম্প্রসারণ: এর জন্য উপযুক্ত আরেকটি খাত হলো তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) এবং বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং (বিপিও)। ডিজিটাল অবকাঠামোতে বিনিয়োগ সম্প্রসারণ এবং বিদেশি আইটি ফার্মগুলোকে বাংলাদেশে কার্যক্রম স্থাপনের জন্য প্রণোদনা প্রদান তরুণদের জন্য হাজার হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে। উপরন্তু সরকার-সমর্থিত উদ্যোগের মধ্য দিয়ে তরুণদের জন্য ডিজিটাল দক্ষতা প্রশিক্ষণের দিকেও মনোযোগ দেওয়া উচিত।
৩. টেকনিক্যাল ও ভোকেশনাল (টিভেট) এবং শিক্ষানবিশ কর্মসূচির সম্প্রসারণকে অগ্রাধিকার দেওয়া: মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরে টিভেট খাতে অংশগ্রহণের হার বর্তমানের ১ দশমিক ২ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। এর পাশাপাশি সরকারকে শিল্পোদ্যোক্তাদের সঙ্গে মিলে শ্রমবাজারের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কর্মসূচির নকশা পরিবর্তন করতে হবে। তরুণদের জন্য ভালো বেতনের বৃত্তিমূলক চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করতে আইটি, ইলেকট্রনিকস সমাবেশ এবং নির্মাণের মতো সেক্টরগুলোতে মনোযোগ দিতে হবে। বেকারত্ব কমানোর পাশাপাশি এটি উচ্চশিক্ষা–ব্যবস্থার ওপর চাপও কমিয়ে দেবে।
৪. শ্রমবাজার ও যুবনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হোক ‘শ্রম দক্ষতা উন্নয়ন’: ভবিষ্যৎ নির্বাচিত সরকারকে দেশের যুব গোষ্ঠীকে একটি সুসংগঠিত ও উৎপাদনশীল শক্তিতে পরিণত করতে একটি ‘দক্ষতা প্রথম’ নীতিমালা গ্রহণের অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে। এই লক্ষ্যে বিদ্যমান স্কিলিং ইকোসিস্টেম এবং এর প্রশাসনিক কাঠামো পুনর্বিবেচনা ও পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। ‘জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতি ২০২১’ এবং ‘দক্ষতা উন্নয়নের জন্য জাতীয় কর্মপরিকল্পনা ২০২২-২০২৭’–এর অধীনে বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় কারিগরি ও বৃত্তিমূলক যোগ্যতা কাঠামো এবং জাতীয় দক্ষতার কার্যকারিতা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা এবং পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন।
৫. দক্ষতা প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামের সম্প্রসারণ ও উৎকর্ষ বৃদ্ধি: বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ (যেমন নতুন দক্ষতা, আপ-স্কিলিং, রি-স্কিলিং, শিক্ষানবিশ, আরপিএল ও উদ্যোক্তা) প্রদানে দায়িত্বরত রয়েছে ৬১টি সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা। এদের মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে হবে এবং এসব প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামের ব্যবহার হার যাচাইয়ের পাশাপাশি প্রোগ্রামের স্বীকৃতি, গুণগত মান নিশ্চিত এবং কার্যকারিতা পর্যালোচনা করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি দক্ষতা প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে দেশব্যাপী অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ (যেমন চাকরি মেলা) বাড়াতে হবে।
৬. যুব উদ্যোক্তা ও স্বকর্মসংস্থান উৎসাহিত করা: বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণের সাফল্য সত্ত্বেও অনেক তরুণ-তরুণী ব্যবসা শুরু করার জন্য প্রয়োজনীয় মূলধন থেকে বঞ্চিত। গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা এবং ক্ষুদ্রঋণের পথপ্রদর্শক প্রফেসর ইউনূস তরুণ উদ্যোক্তাদের এই সংকট নিরসন করতে পারেন। টার্গেটেড স্টার্টআপ লোন, ভর্তুকিযুক্ত দক্ষতা প্রশিক্ষণ কর্মসূচি এবং ট্যাক্স প্রণোদনা যুবকদের স্বনির্ভর ও উদ্যোক্তা হতে উৎসাহিত করবে। শিল্প-নির্দিষ্ট প্রশিক্ষণ কর্মসূচিগুলো বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে সহযোগিতায় ডিজাইন করা উচিত, যাতে শেখানো দক্ষতা নিয়োগকারীদের চাহিদার সঙ্গে মেলে।
৭. সক্রিয় শ্রমবাজার নীতির আধুনিকীকরণ: এর বাস্তবায়নে সরকারের উচিত একটি ইকোসিস্টেম তৈরি করা, যার মধ্যে চাকরির/জব ম্যাচিং পরিষেবা, ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং এবং দক্ষতা পুনঃপ্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সরকার তরুণদের চাকরির সুযোগের সঙ্গে সংযুক্ত করতে এবং বিডি জবসের মতো বেসরকারি খাতের চ্যাম্পিয়নদের সঙ্গে অংশীদার করতে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের সুবিধা নিতে পারে। যোগাযোগ ও বিদেশি ভাষা–সম্পর্কিত পুনঃপ্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম, কম্পিউটিং, ডেটা ম্যানেজমেন্ট এবং টিমওয়ার্ক দক্ষতাগুলোতে বিনিয়োগ করা, যা মূলত আমাদের শিক্ষা পাঠ্যক্রম থেকে অনুপস্থিত।
৮. কর্মসংস্থানে আঞ্চলিক অসংগতি ও বৈষম্য দূর করা: শহুরে যুবকদের জন্য পাবলিক ট্রান্সপোর্ট, নগর–পরিকল্পনায় এবং স্মার্ট সিটির মতো শহুরে অবকাঠামো প্রকল্পগুলোতেও বিনিয়োগ করা উচিত, যা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয় কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করবে। গ্রাম থেকে শহরের শ্রমবাজারে অভিবাসন প্রকল্প চালু করতে হবে। একই সঙ্গে গ্রামীণ শ্রমবাজার স্থানীয় উন্নয়নে সরকারের উচিত কৃষি ব্যবসা, গ্রামীণ পর্যটন এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্পে মনোযোগ দেওয়া। কোল্ড স্টোরেজ, সেচব্যবস্থা এবং পরিবহন নেটওয়ার্কের মতো গ্রামীণ অবকাঠামোতে বিনিয়োগ শুধু কৃষি উৎপাদনশীলতাই উন্নত করবে না; বরং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে জাতীয় গ্রামীণ জীবিকা মিশন এবং স্বর্ণজয়ন্তী গ্রামীণ স্বরোজগার যোজনা প্রকল্প কর্মসংস্থানের মাধ্যমে গ্রামীণ দরিদ্রদের স্বনির্ভর গোষ্ঠীতে সংগঠিত করতে বিশেষ অবদান রেখেছে।
৯. শ্রমবাজারে নারীদের সামাজিক সুরক্ষানীতি জোরদার করা: যুবকদের তুলনায় নারীদের বেকারত্ব বেশি এবং তাদের সিংহভাগই শ্রমবাজারের বাইরে। কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য ও যৌন হয়রানি বন্ধে পদক্ষেপ, সাশ্রয়ী মূল্যের চাইল্ড কেয়ার সেন্টার এবং আইনি সুরক্ষা বৃদ্ধি নারীদের আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানে আকৃষ্ট করবে। পাশাপাশি জেন্ডার-টার্গেটেড স্কলারশিপ, মেন্টরশিপ প্রোগ্রাম ও প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণের উদ্যোগ, বিশেষ করে আইটি ও স্বাস্থ্যসেবা খাতে গুরুত্বপূর্ণ। নারী উদ্যোক্তাদের সহায়তায় ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচিও কার্যকর হবে।
১০. শ্রমবাজার সম্প্রসারণে বৈদেশিক অভিবাসনকে একটি ‘নিরাপত্তা ভাল্ব’ হিসেবে কার্যকর করা: শিক্ষিত চাকরিপ্রার্থীদের জন্য স্বল্পকালীন বৈদেশিক কর্মসংস্থান আকর্ষণীয় করতে হবে এবং রপ্তানিভিত্তিক চাহিদা অনুযায়ী যুব কর্মশক্তিকে নতুনভাবে ব্র্যান্ড করা জরুরি। প্রবাসে শ্রম অধিকারবিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামগুলো শক্তিশালী করার পাশাপাশি অভিবাসন-পূর্বোত্তর ভাষা ও দক্ষতাভিত্তিক প্রশিক্ষণ বাড়াতে হবে। প্রবাসে কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ নিশ্চিত করতে গন্তব্য দেশের সরকারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় শ্রম চুক্তিকে শক্তিশালী করা এবং বাংলাদেশি পেশাদারদের বিদেশে অর্জিত অভিজ্ঞতা এবং নতুন দক্ষতা ও নেটওয়ার্কের সঙ্গে দেশে ফেরার জন্য ভিসাব্যবস্থার পুনঃ আলোচনা অত্যাবশ্যকীয়। একইভাবে মাইগ্রেন্ট এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ প্রোগ্রাম চালু করে প্রবাসীদের দেশে উদ্যোক্তা হিসেবে কাজে লাগানো, যাতে বিদেশি শ্রমবাজারের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে শ্রমিকেরা দেশে এসে উদ্যোক্তা হতে পারেন।
ওপরের ১০ দফা কর্মসূচিতে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের প্রস্তাব রয়েছে, যা শ্রমবাজারের চাপ কমানো, বৈষম্য হ্রাস এবং বেকারত্ব সংকট মোকাবিলায় কার্যকর হবে। এর বাস্তবায়নে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রয়োজন নিও-লিবারেল অর্থনৈতিক মডেলের বাইরে চিন্তা করা। অগ্রাধিকার দিতে হবে আত্মকর্মসংস্থানকারী উদ্যোক্তা, যুবক ও নারী কর্মীদের এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের। পাশাপাশি নিশ্চিত করতে হবে শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা, দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ, সামাজিক সুরক্ষা এবং অভিবাসী শ্রমব্যবস্থার সংস্কার।
প্রথম প্রকাশ : প্রথম আলো, ০৫ নভেম্বর ২০২৪