বিতর্ক, সন্দেহ আর আস্থাহীনতার ঘেরাটোপ থেকে কোনোভাবেই যেন বের হয়ে আসতে পারছে না আমাদের নির্বাচন কমিশন। সর্বাধিক বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে কমিশনের আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়ে।
‘অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ইভিএমে বিশ্বাস করছে না’—সিইসির এ বক্তব্যের পর হঠাৎ করেই কমিশন ১৫০টি আসনে ইভিএম ব্যবহারের ঘোষণা দেয়। সিইসির দাবি অনুযায়ী, এ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে কমিশন রাজনৈতিক দলের মতামতের ওপর গুরুত্ব দেয়নি। কারণ, নির্বাচন সুষ্ঠু করার দায়িত্ব কমিশনের। কিন্তু পরে নির্বাচন নিয়ে নিজেদের কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করতে গিয়ে অন্য কমিশনাররা দাবি করেন যে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল ইভিএমের পক্ষে, যদিও বাস্তবে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল এর বিপক্ষে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে এ দাবি করতে গিয়ে তাঁরা প্রতারণামূলকভাবে রাজনৈতিক দলের বক্তব্যকে পাল্টে দিয়েছেন।
ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে কমিশন একটি বিভ্রান্তিকর ধূম্রজালও সৃষ্টি করেছে। কমিশন দাবি করছে যে ইভিএম দিয়ে ভোট জালিয়াতি করা যায়, কেউ তা প্রমাণ করতে পারেনি। ইভিএম দিয়ে অন্য কেউ জালিয়াতি করতে পারে, সে অভিযোগ এখনো কেউ করেনি, যদিও কমিশনের যোগসাজশে তা করা সম্ভব।
বরং সমালোচকদের সন্দেহ নির্বাচন কমিশনকে নিয়েই তাদের সন্দেহ কমিশনের কর্মকর্তা, কারিগরি টিম এবং নির্বাচনের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রিসাইডিং বা সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তারাই ইভিএম দিয়ে সম্পূর্ণ অদৃশ্যভাবে ডিজিটাল কারসাজি করতে পারেন।
আর যেহেতু কমিশনই সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে পেপার ব্যালটের পরিবর্তে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাই কমিশনকেই ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ বন্ধ করে, প্রশ্নাতীতভাবে প্রমাণ করতে হবে যে ইভিএম ব্যবহার করে ভোট জালিয়াতি করা যায় না। ‘বর্ডেন অব প্রুফ’ বা প্রমাণ করার দায়িত্ব কমিশনের, অন্য কারও নয়। বাইরের কাউকে তা প্রমাণ করতে হলে তাদের একটি ইভিএম ও এর সোর্স কোড দিতে হবে। কমিশন কি তাতে রাজি? আমরা কমিশনের প্রতি সেই চ্যালেঞ্জ রাখছি।
সিইসির নিজের স্বীকৃতি অনুযায়ীই, কমিশন গুরুতর আস্থার সংকটের মধ্যে আছে। ইভিএম নিয়ে অতি উৎসাহ এ সংকটকে আরও ঘনীভূত করেছে। কারণ, ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে শুধু রাজনৈতিক দলেরই নয়, কমিশন নাগরিক সমাজ ও সাধারণ জনগণের মতামতও উপেক্ষা করেছে। তদুপরি তারা বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ইভিএম কেনার উদ্যোগ নিচ্ছে, যখন সরকার সংকট উত্তরণের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছ থেকে সাত বিলিয়ন ডলার ধার করার চেষ্টা করছে।
আমাদের আশঙ্কা যে যত দিন পর্যন্ত যেসব কারণে ইভিএম নিয়ে মানুষের সন্দেহ রয়েছে সেগুলো দূর না হবে, তত দিন পর্যন্ত কমিশনের আস্থার সংকট দূরীভূত হবে না আর কমিশনকেই সে দায়িত্ব নিতে হবে। প্রসঙ্গত, ইভিএমে ভোট চুরি হয়, এমন সন্দেহে চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সর্বশেষ নির্বাচনে উভয় প্যানেলই ইভিএম ব্যবহারের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। ইভিএম নিয়ে সন্দেহের কারণগুলো হলো:
ইভিএমে ভোটার ভেরিফায়েড পেপার অডিট ট্রেইল নেই
আমাদের ইভিএমের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো, এতে ‘ভোটার ভেরিফায়েড পেপার অডিট ট্রেইল’ (ভিভিপিএটি) নেই, যার ফলে ভোটের ফলাফল পুনর্গণনা বা অডিট করা যায় না। অর্থাৎ নির্বাচন কমিশন যে ফলাফল দেবে, তা-ই গ্রহণ করতে হবে। আর এ দুর্বলতার কারণেই ২০১৮ সালে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক গঠিত কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির প্রধান বুয়েটের সাবেক উপাচার্য প্রয়াত জামিলুর রেজা চৌধুরী বর্তমান ইভিএম কেনার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। এ ধরনের দুর্বলতা কাটাতেই ভারতের সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সেখানকার ইভিএমে ভিভিপিএটি যুক্ত করা হয়েছিল।
কর্মকর্তাদের ইভিএমকে ওভাররাইড করার ক্ষমতা রয়েছে
কর্মকর্তাদের ইভিএমকে ওভাররাইড করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। প্রিসাইডিং কর্মকর্তা যদি ভোটারের উপস্থিতিতে নিজের আঙুলের চাপ দিয়ে ভোট দেওয়ার জন্য ইভিএম খুলে দিতে পারেন, তাহলে ভোটারের অনপুস্থিতিতেও তিনি নিজের ইচ্ছেমতো যেকোনো সংখ্যক ভোট তিনি দিতে পারবেন কেউ তা দেখবে না এবং জানবে না, যার মাধ্যমে ভোটের ফলাফল বদলে দেওয়া সম্ভব। বিবিসির এক রিপোর্ট অনুযায়ী, গত জাতীয় নির্বাচনে ২৫ শতাংশ ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের ওভাররাইড করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন হলে, সামান্য কয়েক শতাংশ ভোটের ব্যবধানেই জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়।
ভোটদান ডিজিটাল, কিন্তু ফলাফল তৈরি ম্যানুয়াল
সব কেন্দ্রের ইন্টিগ্রেটেড ফলাফল স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি করতে বর্তমান ইভিএম সক্ষম নয়, যা এর বড় দুর্বলতা। এ কারণেই ইভিএমে ভোট হলেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে যায় ভোটের চূড়ান্ত ফলাফল পেতে। এর কারণ অডিট কার্ডের মাধ্যমে বুথের ফলাফল হস্তান্তরের পর ম্যানুয়ালি চূড়ান্ত ফলাফল তৈরি করতে হয়, যে প্রক্রিয়ায় ভোটের ফলাফল বদলে দেওয়া যায়।
প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে ইভিএমকে প্রস্তুত করতে হয়
ইভিএম একটি জড় পদার্থ এবং এটিকে প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে কমান্ড দিয়ে পরিচালনা করতে হয়। প্রত্যেক নির্বাচনে প্রত্যেক আসনের জন্য প্রোগ্রামিং করে ইভিএমকে কনফিগার করতে হয়, কারণ প্রত্যেক আসনের জন্য ভিন্ন ভিন্ন প্রার্থী থাকে। এই প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমেও ইভিএম দিয়ে জালিয়াতি করা যায়।
কমিশনের কারিগরি টিম ভোটের ফলাফল পাল্টে দিতে পারে
ইভিএম যন্ত্র নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং এর কারিগরি টিম ভোটের ফলাফল বদলে দিতে পারে। অনেকেরই স্মরণ আছে যে গত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অন্তত দুবার ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছিল, ডিজিটাল জালিয়াতির মাধ্যমেই যা সম্ভব হয়েছিল বলে অনেকের ধারণা। যে অডিট কার্ড দিয়ে ভোটের ফলাফল হস্তান্তর করা হয়, তা ডুপ্লিকেট বা দ্বিতীয় সেট তৈরি করেও ভোটের ফল পাল্টে দেওয়া যায়।
একটি কেন্দ্রের সব বুথের মাস্টার ডেটাবেজ নেই
একটি কেন্দ্রের সব ভোটারের তথ্য সব পুলিং বুথে থাকে না। ফলে একটি বুথের ইভিএম কাজ না করলে, নষ্ট হলে বা ইভিএমে ভোটারের বায়োমেট্রিক শনাক্ত করা না গেলে, অন্য ইভিএমে তাদের ভোট নেওয়া যায় না।
বায়োমেট্রিকভিত্তিক ইভিএম নাগরিকদের ভোটাধিকার হরণ করে
বায়োমেট্রিকস বা আঙুলের চাপ দিয়ে ভোটার শনাক্তকরণে জটিলতা, ভোটারদের অসচেতনতা ও মেশিন হ্যাং হওয়ার কারণে ইভিএম মানুষের ভোটাধিকার হরণ করে। গত জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারকারী ছয়টি আসনে অন্য ২৯৪টি আসনের তুলনায় ভোট পড়ার হার ছিল ৩০ শতাংশ কম। তাই ভোটাধিকার হরণকারী যন্ত্র দিয়ে ভোট নেওয়ার যৌক্তিকতা অযৌক্তিক।
ইভিএম একটি ব্ল্যাকবাক্স, যার স্বচ্ছতা নিয়ে জনমনে সন্দেহ থাকে
ব্যালট ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভোটার নিজের হাতে সিল মেরে তা স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সে ফেলার পর তা প্রার্থীর এজেন্টের সামনে বা প্রকাশ্যে গণনা করা হয়। পুরো প্রক্রিয়াই স্বচ্ছ ও বহুলাংশে দৃশ্যমান। অন্যদিকে ইভিএমে ভোট প্রদান প্রক্রিয়া দৃশ্যমান নয়, ফলে ভোটারদের মনে সন্দেহ সৃষ্টি হয়। ইভিএমে ভোটের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হলে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ হতে হয়—এ যুক্তিতে জার্মান আদালত ইভিএম ব্যবহার বেআইনি ঘোষণা করেছেন। এসব কারণে পৃথিবীর ১৭৮টি দেশের মধ্যে মাত্র ১৩টি দেশ বর্তমানে সব ক্ষেত্রে ইভিএম ব্যবহার করে থাকে।
ইভিএম আমাদের দেশের জন্য উপযোগী নয়
আমাদের আবহাওয়ায় অধিক পরিমাণের আর্দ্রতার কারণে দীর্ঘদিন অব্যবহৃত থাকলে ইভিএম নষ্ট হয়ে যেতে পারে। নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী, ৯৩ হাজার ৪১০টি ইভিএমের ৩০ শতাংশ এ মুহূর্তে অকেজো হয়ে গেছে আর ঝুঁকিতে রয়েছে ৬৫ হাজার (যুগান্তর, ৭ আগস্ট ২০২২)।
নিখুঁত এনআইডি এবং বায়োমেট্রিক তথ্যভান্ডার এখনো তৈরি হয়নি
সব প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের নিখুঁত বায়োমেট্রিক তথ্যভান্ডার সঠিকভাবে তৈরি হয়নি বলে নির্বাচন কমিশনে জাতীয় পরিচয়পত্রবিষয়ক (এনআইডি) লাখ লাখ অভিযোগ উঠেছে। আরেকটি নতুন সমস্যা হলো প্রায় পাঁচ কোটি নাগরিকের জন্মনিবন্ধনের তথ্য হারিয়ে যাওয়া। ২০২৩ সালের মধ্যে কোটি কোটি নাগরিকের জন্মনিবন্ধন ও এনআইডি তৈরিসহ বিদ্যমান এনআইডির কোটি কোটি ভুল শোধরানো অসম্ভব। তাই যেখানে নিখুঁত এনআইডি এবং বায়োমেট্রিক তথ্যভান্ডারই তৈরি হয়নি, সেখানে ১৫০টি আসনে ইভিএম ব্যবহার সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।
*লেখাটি ‘ইভিএম নিয়ে সন্দেহ ইসিকেই দূর করতে হবে’ শিরোনামে প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয়েছিল।
ইভিএম নিয়ে ধূম্রজাল নির্বাচন কমিশন কেবল তখনই দূর করতে পারবে যখন তাঁরা কেবল মুখে নয় কাজের মাধ্যমে জনমনে আস্থা অর্জন করতে পারবে যে তাঁরা আসলেই অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিবেশ ও ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পেরেছেন । বাংলাদেশের মানুষের আজ সবচেয়ে বড় সংকট তাঁরা টোট্যাল সিস্টেম এর উপর আস্থা বিশ্বাস হারিয়েছেন।। এই রকম অবস্থা সৃষ্টির পিছনে সরকার, রাজনৈতিক দল এবং নির্বাচন কমিশন স্বয়ং দায়ী।