এই শতাব্দীর শুরুর দিকে ডিজিটাল প্রযুক্তি সাধারণ মানুষের সাধ্যের মধ্যে আসা শুরু করে। যাঁরা রাজনীতিতে প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেন, তাঁদের অনেকেই মনে করেছিলেন ডিজিটাল মিডিয়া রাজনীতিতে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে। মনে করা হয়েছিল, ইন্টারনেটে সংযুক্ত থাকার কারণে সাধারণ মানুষ অবাধ তথ্যপ্রবাহ পাবে, সহজে যোগাযোগ করতে পারবে এবং প্রতিবাদের জন্য সংগঠিত হতে পারবে, এর ফলে বিশ্বজুড়ে কর্তৃত্ববাদী সরকারের টিকে থাকা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসে তিউনিসিয়া থেকে শুরু হয়ে সরকারবিরোধী প্রতিবাদ উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কটি দেশের দীর্ঘ কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলোর ভিত্তি নাড়িয়ে দেয়। আরব বসন্ত নামে পরিচিত এই সিরিজ প্রতিবাদ নিয়ে আশাবাদের কমতি ছিল না।
এই প্রতিবাদগুলো সংগঠিত হওয়ার পেছনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম একটা বড় ভূমিকা রেখেছিল বলে মনে করা হয়। গবেষকেরাও মনে করেছিলেন ডিজিটাল মিডিয়া জনগণকে প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর দিয়েছে, তার ফলে স্বৈরাচারীদের দিন শেষ হয়ে আসছে। আরব বসন্তের এক দশক পরে আজকের বিশ্বের রাজনীতির দিকে তাকালে ডিজিটাল মিডিয়াকে শুধু মুক্তির প্রযুক্তি বলা যাচ্ছে না।
বরং আজ বিশেষজ্ঞ ও গবেষকদের মধ্যে এ নিয়ে মোটামুটি ঐকমত্য তৈরি হয়েছে যে ডিজিটাল মিডিয়া একটি দ্বিমুখী ধারালো তরবারির মতো: এই প্রযুক্তি শুধু মুক্তি দেয় না, মুক্তির পথকে অবরুদ্ধও করতে পারে। এটা নির্ভর করে কে কোন উদ্দেশ্যে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করছে তার ওপর।
কোভিড-১৯ মহামারিকালে তথ্যপ্রবাহে কর্তৃত্ববাদী সরকারি নিয়ন্ত্রণকে জায়েজ করা হয়েছে। নিবর্তনমূলক প্রযুক্তি ও আড়িপাতা যন্ত্রপাতির ব্যবহারকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। ভুয়া তথ্য প্রচার বন্ধের নামে স্বাধীন সংবাদমাধ্যমগুলোকে বন্ধ করা বা চাপের মধ্যে রাখা হয়েছে। অথচ অনেক ক্ষেত্রে সরকারের মন্ত্রী, দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ও সমর্থকেরাই ভুয়া তথ্য ছড়িয়েছেন।
কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো ইন্টারনেটে বিরোধী মতকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে এবং নিজের স্বার্থে ব্যবহার করছে, তা নিয়ে আলোচনা প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফ্রিডম হাউস ২০২০ সালের এক গবেষণায় তিনটি সূচক দিয়ে ইন্টারনেট কতটুকু মুক্ত, তা পরিমাপ করেছে। তথ্যপ্রবাহে বাধা, কনটেন্ট সীমাবদ্ধ করা এবং ব্যবহারকারীর অধিকার লঙ্ঘন করা—এই তিনটি উপায়ে কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো ডিজিটাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করছে।
বিশ্বব্যাপী কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলোর ডিজিটাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের পাঁচটি কৌশল লক্ষ করা যায়। প্রথমত, তাদের সবচেয়ে প্রিয় নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা হচ্ছে সেন্সরশিপ। এর মূল লক্ষ্য সরকার–বিরোধী মতামত প্রচারে বিঘ্ন ঘটানো। চীনের সেন্সরশিপ ব্যবস্থাকে ‘গ্রেট ফায়ারওয়াল’ বলা হয়, যেখানে সরকারি সংস্থা ও প্রাইভেট কোম্পানিগুলো একসঙ্গে সরকারবিরোধী কনটেন্ট ও তথ্যের প্রচার বন্ধে কাজ করে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির সাহায্যে ছবি ও টেক্সট পরীক্ষা করে ফিল্টার করা হয় অথবা ব্লক করে দেওয়া হয়। অনেক সময় কর্তৃত্ববাদী সরকারের পক্ষ থেকে বিভ্রান্তি ছড়াতে তথ্য বিকৃত করা হয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভ্রান্তিমূলক পোস্ট দিয়ে ‘নয়েজ’ তৈরি করা হয়। এসব কৌশলও যদি ব্যর্থ হয়, তবে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ইন্টারনেট শাটডাউন বা সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়, অনেক ক্ষেত্রে সংযোগের গতি এমনভাবে কমিয়ে দেওয়া হয় যেন প্রায় ব্যবহারের অনুপযুক্ত হয়ে যায়। ২০১৯ সালে রাশিয়ায় ও ইরানে সরকারবিরোধী বিক্ষোভের সময় ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়েছিল।
দ্বিতীয় কৌশলটি হচ্ছে বিরোধীদের চিহ্নিত করা ও দমন করা। নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে সরকার দ্রুত জনগণের তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। ফেসিয়াল রিকগনিশন, স্পাইইং ম্যালওয়্যার, বিগ ডেটা প্রসেসিং, স্বয়ংক্রিয় টেক্সট অ্যানালাইসিসের মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে সরকারবিরোধীদের চিহ্নিত করা এখন খুবই সহজ।
আগের দিনে কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলোকে জনগণের ওপর নজরদারি ও তথ্য সংগ্রহ করার জন্য অনেক কষ্ট পোহাতে হতো। জন কোহলারের এক গবেষণায় দেখা যায়, পূর্ব জার্মানিতে নজরদারির জন্য প্রতি ৬৬ জনে ১ জনকে চর নিয়োগ করা হয়। এই যে বিপুল আয়োজন, প্রশিক্ষণ ও অর্থ খরচ, তা সব সরকার করতে পারত না।
কিন্তু এখন ডিজিটাল মিডিয়া, বিশেষ করে ফেসবুক, টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নজরদারি সহজ করেছে। কারণ, জনসাধারণ এখন নিজেই নিজের ব্যক্তিগত তথ্য, ছবি ও মতামত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরবরাহ করছে।অল্প কিছু নজরদারির প্রযুক্তি, আর সরকারি সংস্থার কিছু প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকবলই এখন নজরদারির জন্য যথেষ্ট।
এর সঙ্গে জড়িত তৃতীয় কৌশলটি, যেখানে সামাজিক মাধ্যমে নজরদারির মাধ্যমে কর্তৃত্ববাদী সরকার জনমত ও পাবলিক সেন্টিমেন্ট বুঝতে পারে। একই সঙ্গে স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা চালু রাখা এবং সেই নিয়ন্ত্রিত শাসনব্যবস্থায় জনগণ কী ভাবছে, সেটা বুঝে দমন করতে পারার এই বিশেষ সুবিধা এর আগের পুরোনো কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো পায়নি।
জনসাধারণ ছাড়াও নিজেদের মধ্যে, যেমন দলের নেতা-কর্মী, সরকারি কর্মকর্তা ও দলের সমর্থকদের ওপরও নজরদারির সুযোগ করে দিয়েছে নতুন প্রযুক্তি। তাই একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা চলে কে কত বেশি সরকারের স্তুতি গাইতে পারে এবং অন্যায়কে বৈধতা দিয়ে সরকারের বিশ্বস্ত হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে পারে।
ডিজিটাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করা ও বিরোধী মত দমন করার চতুর্থ কৌশলটি হচ্ছে তথ্যপ্রবাহে কারসাজি করা। সরকারের পক্ষে বয়ান তৈরি করে জনসাধারণের মনোযোগ নেতিবাচক সংবাদ থেকে সরিয়ে নেওয়া বিশ্বজুড়ে কর্তৃত্ববাদী সরকারের কাছে প্রিয় কৌশল।
সরকারি প্রচার সংস্থা, গোয়েন্দা বাহিনী ও বেসরকারি প্রচার প্রতিষ্ঠান সাধারণত এই কৌশলের অংশ হয়। সরকারের পক্ষে হাজার হাজার পোস্ট দিয়ে জনমত পরিবর্তন করার চেষ্টা করা হয়, অথবা বিরোধী মতকে জনগণের কাছে পৌঁছাতে বাধা দেওয়া হয়। সরকারের জনপ্রিয়তা তুলে ধরে মিথ্যা তথ্য প্রচারের জন্য টাকার বিনিময়ে কর্মী নিয়োগ করা হয়। অনেক সময় ‘ইন্টারনেট বট’ ব্যবহার করেও সরকারের পক্ষের বয়ানের প্রচার বৃদ্ধি ও বিরুদ্ধমতের প্রচার বাধাগ্রস্ত করা যায়।
পুরোনো কর্তৃত্ববাদী সরকারের সঙ্গে নতুন কর্তৃত্ববাদীর আরেকটি পার্থক্য গণতন্ত্র ও নাগরিক অধিকার প্রশ্নে। নতুন কর্তৃত্ববাদীরা জনগণকে নিয়ন্ত্রিত সুবিধা দিয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদের পরিচিত করে। তাই ডিজিটাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণেও তারা শেষ যে কৌশলটি ব্যবহার করে তা হচ্ছে আপাত নাগরিক অধিকার চর্চার সুযোগ করে দেওয়া। নিয়ন্ত্রিত অনলাইন যোগাযোগ ও সূক্ষ্ম প্রভাব বিস্তার করে সরকার জনগণের মতামতকে নিজের পক্ষে নিয়ে আসে এবং জনগণের মধ্যে নানা বিভেদ তৈরি করে সরকারের অবস্থান পোক্ত করে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এই ধরনের নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা কার্যকর কি না। অনেকে যুক্তি দেখাতে পারেন যে নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা জনগণের মনে অসন্তোষ তৈরি করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে পারে। সুইডেনভিত্তিক ভি-ডেম ইনস্টিটিউটের গবেষণা অনুযায়ী, অনলাইনে যেসব সরকার নিবর্তনমূলক নিয়ন্ত্রণ চালায়, তাদের স্বৈরাচারমূলক সরকার বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয়।
এ ছাড়া সরকারবিরোধী আন্দোলন ঠেকাতেও ডিজিটাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের কৌশলগুলো কার্যকর। তাই বিশ্বব্যাপী কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো টিকে থাকার সঙ্গে ডিজিটাল নিবর্তনমূলক আইন প্রণয়নের একটা সম্পর্ক রয়েছে। চীন ও রাশিয়া বেশ কার্যকরভাবেই ডিজিটাল মিডিয়ায় বিরোধী মত নিয়ন্ত্রণ করছে এবং তাদের নিয়ন্ত্রণের মডেল অনেক দেশের সরকার অনুকরণ করছে। চীনা কোম্পানি হুয়াওয়ে এই এক ডজনের বেশি দেশে আড়ি পাতা প্রযুক্তি সরবরাহ করেছে।
ইসরায়েলের প্রাইভেট কোম্পানিগুলোও অ্যাঙ্গোলা, বাহরাইন, কাজাখস্তান, মোজাম্বিক, নিকারাগুয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে এ ধরনের প্রযুক্তি বিক্রি করেছে। বিশেষ করে নজরদারি প্রযুক্তি ব্যবহার কতটুকু নাগরিক অধিকার হরণ করতে পারে, তা উইঘুরের মুসলমানদের ওপর চীনের নিয়ে ব্যবস্থা একটি উদাহরণ হতে পারে।
চীন বা রাশিয়ার মতো তীব্র না হলেও যুক্তরাষ্ট্রেও ইন্টারনেটে নজরদারির প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কমিউনিকেশন কমিশন ইন্টারনেট নিরপেক্ষতামূলক আইন বাতিল করেছে। সিভিল রাইটস ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তার বিরুদ্ধে ফিসা অ্যাক্টকে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস বৈধতা দিয়েছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতেও নিবর্তনমূলক ডিজিটাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ ও নাগরিক অধিকার হরণের প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে।
বিশ্বব্যাপী কর্তৃত্ববাদী সরকারের ডিজিটাল মিডিয়ার ওপর নিবর্তনমূলক নিয়ন্ত্রণের একটি বড় কারণ হচ্ছে জনভিত্তি না থাকা। নিয়ন্ত্রণের এই কৌশলগুলোর প্রায় সবই বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে বিরোধী মতকে দমনের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। এই কৌশলগুলো কর্তৃত্ববাদী সরকারব্যবস্থাকে দীর্ঘ মেয়াদে টিকিয়ে রাখতে ও নাগরিক অধিকারকে হরণ করতে কার্যকরী, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। তবে যত দিন এই ধরনের নিবর্তনমূলক নীতি থেকে সরকারকে নিবৃত্ত করা না যাবে, তত দিন সত্যিকারের গণতন্ত্র চর্চা ও প্রতিষ্ঠা অধরাই থাকবে।