বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের নতুন মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী (মাস্টারপ্ল্যান ২০২৩-আইইপিএমপি), ২০৫০ সালে দেশে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা বেড়ে দাঁড়াবে ৭১ হাজার ৫১২ মেগাওয়াট, উৎপাদন-সক্ষমতা হতে পারে ১ লাখ ১১ হাজার মেগাওয়াট, যা চাহিদার চেয়ে ৫৫ শতাংশ বেশি।
এ পরিকল্পনায় শুধু গ্যাস নয়, বরং ক্লিন এনার্জির নামে জলবিদ্যুৎ আমদানিসহ সবুজ হাইড্রোজেন ও অ্যামোনিয়া আমদানিকে উৎসাহিত করা হয়েছে। বিদ্যুৎ খাতকে ২০৫০ সাল পর্যন্ত আমদানিনির্ভর করে ফেলে রাখার বিদেশি পরিকল্পনা করা হয়েছে।
স্পষ্টতই, ডলার-সংকটের কারণে ২০২২-২৩ সালে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় যে জ্বালানিসংকট (তেল, গ্যাস ও কয়লা আমদানি) হয়েছে, তা থেকে সরকার শিক্ষা নেয়নি।
অত্যন্ত অদূরদর্শীভাবে মহাপরিকল্পনায় সৌরবিদ্যুৎ, বর্জ্যবিদ্যুৎসহ নবায়নযোগ্য অপরাপর কিছু বিদ্যুৎকে শুধু প্রাধান্যই দেয়নি, ব্যাটারি স্টোরেজকে শতভাগ বাদই দেওয়া হয়েছে।
যেখানে পোশাকশিল্পে বাংলাদেশের প্রধানতম প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ ভিয়েতনাম ২০২২-২৩ সালে এক বছরেই ১০ হাজার মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য বাস্তবায়ন করে ফেলেছে সফলভাবে, সেখানে নতুন পরিকল্পনায় বাংলাদেশকে মাত্র ৬ হাজার মেগাওয়াটের ল্যান্ডমার্ক অতিক্রম করতে ২০৫০ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে—এটা চরম অদূরদর্শী।
মূলত এখানে দুটি জ্বালানি ও বিদ্যুৎ-বাণিজ্যের লবি কাজ করে থাকতে পারে। অরুণাচলে উৎপাদিত জলবিদ্যুৎ সঞ্চালনে ভারতকে দেওয়া বিদ্যুৎ-করিডর সচল করার অর্থাৎ করিডর ব্যবহারের পাশাপাশি বাংলাদেশে জলবিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিক্রির কৌশল আছে।
তবে যমুনা নদীর পানি ভারতের বৃহৎ আন্তনদী-সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে ভিন্ন রুটে প্রবাহিত করার ভয় আছে, দেশের স্বাদু পানির প্রধানতম উৎস যমুনা নদীর গ্রীষ্মকালীন প্রবাহ সংকুচিত হওয়ার ঝুঁকি আছে, যা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে মরুকরণ ত্বরান্বিত করতে পারে।
অন্যদিকে আছে জাপান থেকে হাইড্রোজেন ও অ্যামোনিয়া আমদানির কৌশল। সৌরশক্তির সবচেয়ে সম্ভাবনাময় খাত রুফটপ সোলারকে (সৌরছাদ) উল্লেখযোগ্য গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এভাবে আমদানিনির্ভরতা ও কমিশনের জালে আটকে থাকছে বাংলাদেশের একের পরে এক বিদ্যুৎ মহাপরিকল্পনা।
পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ২০৫০ সাল পর্যন্ত ৩০০ বিলিয়ন ডলার খরচ ধরা হয়েছে। মাস্টারপ্ল্যানে ২০৫০ সাল পর্যন্ত জ্বালানি অবকাঠামো খাতে খরচ ধরা হয়েছে ১৭৯ বিলিয়ন ডলার।
বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে খরচ ধরা হয়েছে ১১৮ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। এমন অতি উচ্চাভিলাষী ও অবাস্তব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে দেশ দীর্ঘ মেয়াদে আমদানির পাশাপাশি ঋণের ফাঁদেও আটকে যাবে।
পরিকল্পনা মতে, ২০৩০ সালে দেশে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা বেড়ে দাঁড়াবে ২৭ হাজার ৮৭ মেগাওয়াট, বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা থাকবে ৪১ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট; চাহিদার চেয়ে যা ৫২ দশমিক ৮৪ শতাংশ বেশি।
২০৪১ সালে বিদ্যুতের চাহিদা ধরা হয়েছে ৫০ হাজার ৩৬৪ মেগাওয়াট, এর বিপরীতে উৎপাদনের সক্ষমতা রাখতে বলা হয়েছে ৭৪ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট, যা চাহিদার চেয়ে ৪৭ শতাংশ বেশি। ২০৫০ সালের চাহিদার চেয়ে যা ৫৫ শতাংশ বেশি।
উৎপাদনের সক্ষমতার দিক থেকে তিনটি প্রাক্কলনই অগ্রহণযোগ্য, কেননা চাহিদার তুলনায় সর্বোচ্চ ১৫ থেকে ২০ শতাংশের বেশি সক্ষমতা অদক্ষ বিদ্যুৎ উৎপাদনব্যবস্থার জানান দেয়। উল্লেখ্য, জাইকার ‘পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যান ২০১০, ২০১৬’—উভয়ের প্রাক্কলনই বিগটাইম ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে।
নতুন পরিকল্পনায় বিদ্যুৎকেন্দ্রের অলস বসে থাকার প্রবণতা আগামী দিনে আরও বাড়বে, এরই মধ্যে বাংলাদেশ অলস বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জের আর্থিক বোঝার কারণে ভুগছে।
২০২৩ মাস্টারপ্ল্যানে ধরা হয়েছে, ২০৫০ সাল নাগাদ বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতার ১১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট হবে কয়লার (১০ শতাংশ), ৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট জ্বালানি তেলের (৬ শতাংশ), ২৯ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট গ্যাস ও এলএনজির (২৭ শতাংশ), ৪ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের (৪ শতাংশ), ২০ হাজার মেগাওয়াট বায়ুবিদ্যুৎ (১৮ শতাংশ), ৬ হাজার মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ (৬ শতাংশ), ১১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট হাইড্রোজেন (১০ শতাংশ), ৫ হাজার মেগাওয়াট অ্যামোনিয়াভিত্তিক (৫ শতাংশ), ১ হাজার মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ (১ শতাংশ) এবং ১৫ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট ভারত থেকে আমদানি (১৪ শতাংশ) করা হবে।
এই প্রাক্কলন জাতিসংঘ শক্তি সংস্থার ‘বৈশ্বিক নিট জিরো’ ২০৫০ মান পরিকল্পনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
পরিকল্পনায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের মূল জ্বালানি হিসেবে গ্যাসকেই রাখা হয়েছে, ২০৪১ সালে গ্যাস থেকে ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ থাকছে। গ্যাসের জোগানের জন্য মূলত আমদানি করা ব্যয়বহুল এলএনজির ওপরই নির্ভর করতে হবে, মহাপরিকল্পনার প্রাক্কলন অনুসারে স্থল ও সমুদ্রে সব ধরনের উন্নয়ন ও অনুসন্ধান শেষে ২০৪১ সালের ৪০০ কোটি ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে দেশি গ্যাসের সরবরাহ দাঁড়াবে দিনে ১৭০ কোটি ঘনফুট (বর্তমানে দৈনিক ২১০ কোটি ঘনফুটের কম)।
বাকি ২৩০ কোটি ঘনফুট আমদানিনির্ভর। ২০৫০ সালে গ্যাসের দৈনিক চাহিদা দাঁড়াবে ৫৩০ কোটি ঘনফুট, মূলত আমদানিনির্ভর।
বাংলাদেশের বার্ষিক গড় বায়ুপ্রবাহের নিম্নগতি বিবেচনায় নিলে ২০৫০ সালে ২০ হাজার মেগাওয়াট বায়ুবিদ্যুৎ প্রাক্কলন উচ্চাভিলাষী, তবে যদি সম্ভবপর হয়, এটা দেশের জন্য অবশ্যই ভালো, যা মাস্টারপ্ল্যানের পজিটিভ দিক।
বিপরীতে দেশের সৌরদীপন ক্ষমতা ইউরোপের দেড় গুণ হওয়া সত্ত্বেও ২০৫০ সালে মাত্র ৬ হাজার মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ অগ্রহণযোগ্য।
মনে হতে পারে, জাইকা বাংলাদেশকে চীন থেকে বড় পরিসরে সোলার প্যানেল ও ব্যাটারি আমদানি করতে দিতে চায় না, এ দুটি খাতে চীনের তুলনায় জাপান বেশ পিছিয়ে।
বিপরীতে ১১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট হাইড্রোজেন ও ৫ হাজার মেগাওয়াট অ্যামোনিয়াভিত্তিক যে প্রেসক্রিপশন দেওয়া হয়েছে, তাতে প্রশ্ন জাগে, আমদানির জন্য এত বিপুল পরিমাণ ডলার আসবে কোথা থেকে?
নতুন এনার্জি ও পাওয়ার মাস্টারপ্ল্যান আন্তর্জাতিক প্রস্তাবের সঙ্গে সমন্বিত নয়। আমরা এর বিপরীতে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থার (ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি, আইইএ, জাতিসংঘ) ২০৫০ সালের শূন্য নির্গমন বা নিট জিরো প্রাক্কলনকে যদি পাশাপাশি তুলনা করি, তাহলে নিম্নলিখিত পর্যবেক্ষণগুলো দেখি—
ক. বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যাচ্ছে, ১০ শতাংশ হাইড্রোজেন ও ৫ শতাংশ অ্যামোনিয়া, ১৫ শতাংশ পরিষ্কার হাইড্রোজেনভিত্তিক জ্বালানি (পরিষ্কার অ্যামোনিয়া সবুজ হাইড্রোজেন থেকে তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি), যেখানে হাইড্রোজেনের বৈশ্বিক আইইএ প্রাক্কলন এর অর্ধেকেরও কম (বৈশ্বিক প্রাক্কলন মাত্র ৬ শতাংশ)। নতুন মহাপরিকল্পনা বিশ্বব্যাপী অনুমানের চেয়ে দ্বিগুণ বেশি হাইড্রোজেন-অ্যামোনিয়া প্রস্তাব করেছে। এই ১৫ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানিনির্ভর বলে এটা দেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এবং ডলার ড্রেনিং।
খ. মূলত গ্রিড চাহিদার অতিরিক্ত সবুজ বিদ্যুৎ ব্যবহার করে ইলেকট্রোলাইসিস প্রক্রিয়ায় পানি ভেঙে হাইড্রোজেন তৈরি করা হয়, তারপর খরুচে সরবরাহব্যবস্থায় হাইড্রোজেন পরিবহন করে আবারও খরুচে রিভার্স প্রসেসে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।
যেসব দেশের জাতীয় কিংবা আঞ্চলিক গ্রিড চাহিদার অতিরিক্ত সৌরবিদ্যুৎ (মধ্যপ্রাচ্য) কিংবা বায়ুবিদ্যুৎ (ইউরোপ) কিংবা বায়োমাসসহ অপরাপর নন-নিউক্লিয়ার সবুজ বিদ্যুৎ থাকে, তা দিয়ে হাইড্রোজেন তৈরি হয়।
এ সুযোগ বাংলাদেশের নেই। বিপরীতে নিজস্ব ব্যবহারের জন্য ব্যাটারি স্টোরেজ বেশি উপযোগী। ব্যাটারির দক্ষতা প্রায় ৮০ শতাংশ, যেখানে হাইড্রোজেন সাইকেলের দক্ষতা ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ মাত্র।
এনার্জি ক্যারিয়ার বা দক্ষতার হিসাবে হাইড্রোজেনের কার্যকারিতা মাত্র ৩০ শতাংশ, নতুন ব্যাটারি প্রযুক্তিগুলো হাইড্রোজেনের তুলনায় প্রায় তিন গুণ বেশি দক্ষতার অধিকারী।
তা সত্ত্বেও ২০৫০ সাল পর্যন্ত মাস্টারপ্ল্যানে বাংলাদেশের জন্য কোনো ব্যাটারি এনার্জি স্টোরেজ সিস্টেম (বিইএসএস) সক্ষমতার প্রস্তাব করা হয়নি, যেখানে আইইএ ২০৫০ সালের মধ্যে ৮ শতাংশ বৈশ্বিক বিইএসএস ক্ষমতায় ব্যাটারি স্টোরেজ প্রাক্কলন করেছে। এটি সম্পূর্ণরূপে অগ্রহণযোগ্য।
গ. হাইড্রোজেন-বিদ্যুৎ প্রযুক্তি পুরোনো হলেও খুব খরুচে। ফলে বাণিজ্যিক বিকাশে এটা শৈশব পার করছে মাত্র। সাশ্রয়ী প্রযুক্তিগত অগ্রগতি অর্জিত হলেও হাইড্রোজেন ও অ্যামোনিয়া জ্বালানি সরবরাহে আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড মেনে প্রচুর নতুন অবকাঠামো ও সাপোর্ট সিস্টেমের প্রয়োজন হবে।
আমদানির পাশাপাশি বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করে এত খরচ বহন করা টেকসই পরিকল্পনা নয়। অ্যামোনিয়া পোড়ালে নাইট্রাস অক্সাইড তৈরি করে, যা কার্বন ডাই-অক্সাইডের চেয়ে গ্রিনহাউস গ্যাস হিসেবে ২৭৩ গুণ খারাপ।
তবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বাইরে বাংলাদেশের সারশিল্পে হাইড্রোজেন ও অ্যামোনিয়া দরকার।
ঘ. মহাপরিকল্পনায় ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের জন্য সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ প্রস্তাব করা হয়েছে, যেখানে সে সময়ে বৈশ্বিক লক্ষ্য ৮০ শতাংশ বা কিছু বেশি।
সব মিলিয়ে প্রস্তাবিত পরিকল্পনা জ্বালানি মিশ্রণে বাংলাদেশকে অনেকাংশে আমদানিনির্ভর করবে, যা ২০২২-২৩ সালের মতো অর্থনৈতিক সংকটের পুরাবৃত্তি ঘটাতে পারে। ফলে এর পুনর্বিবেচনা দরকার।
প্রথম প্রকাশ : প্রথম আলো, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৩