Close

গণতান্ত্রিক শাসনের তিনটি উপাদান

গণতান্ত্রিক শাসনের জন্য তিনটি উপাদানকে অপরিহার্য হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। সেগুলো হচ্ছে ১. সর্বজনীন ভোটাধিকার; ২. আইনসভা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদের জন্য নিয়মিত অবাধ, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক, বহুদলীয় নির্বাচন ৩. নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারগুলোর প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা, যার মধ্যে মতপ্রকাশ, সমাবেশ ও সংগঠন তৈরির স্বাধীনতা অন্তর্ভুক্ত।

গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের মুখোশধারীদের আক্রমণ এখন বৈশ্বিক সমস্যা। একদিকে তাঁরা নিজেদের দাবি করেন গণতন্ত্রী বলে, অন্যদিকে তাঁরাই আবার গণতন্ত্রের মূলনীতি এবং শাসনব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। গণতন্ত্র, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, স্বৈরাচারী ব্যবস্থা এবং সরকার বিষয়ে প্রায় চার শ বছরে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের আলোচনায় দেখা গেছে যে গণতন্ত্রের চারটি মূল আদর্শ হচ্ছে জনগণের সার্বভৌমত্ব, প্রতিনিধিত্ব, দায়বদ্ধতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। কিন্তু গণতন্ত্র কেবল কতগুলো আদর্শিক নীতিই নয়, বরং এটি শাসনের একটি পদ্ধতিও। একটি শাসনব্যবস্থায় কী কী থাকলে আমরা তাকে গণতান্ত্রিক বলে বিবেচনা করব?

বিংশ শতাব্দীতে যখন অনেকগুলো দেশ গণতন্ত্রকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে থাকে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের কাছে এই প্রশ্নটাই প্রধান হয়ে ওঠে যে এই মূল আদর্শগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না, সেটা কী দেখে বোঝা যাবে। তাঁদের প্রধান বিবেচ্য বিষয় হয় গণতন্ত্র কীভাবে চর্চা করা হচ্ছে এবং কীভাবে চর্চা করা উচিত। তাঁদের বিবেচনার কেন্দ্রে থাকে শাসনব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্রের কথা। এই সব রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর প্রধানতম হচ্ছেন জোসেফ সুম্পিটার, স্যামুয়েল হান্টিংটন, অ্যাডাম প্রেজরস্কি, গিওভান্নি সার্টোরি, হুয়ান লিঞ্জ ও রবার্ট ডাল।

সুম্পিটারের সংজ্ঞা অনুযায়ী গণতন্ত্র হচ্ছে ‘রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা, যেখানে জনগণের ভোটের মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে কোনো ব্যক্তি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা অর্জন করে।’ হান্টিংটনের মতে, ‘গণতন্ত্র হচ্ছে একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে সর্বাধিক ক্ষমতার অধিকারী সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীরা নির্বাচিত হয় একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও পর্যায়ক্রমিক নির্বাচনের মাধ্যমে। যেখানে প্রার্থীরা স্বাধীনভাবে ভোটের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এবং কার্যত সকল প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীই ভোটদানের উপযুক্ত বিবেচিত হয়।’ প্রেজরস্কি ও অন্যরা দাবি করেন, ‘গণতন্ত্র এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে দলগুলো নির্বাচনে পরাজিত হয়।’ সুতরাং এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে: ১. পূর্বানুমানের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা ২. ফলাফল প্রাপ্তির পর অপরিবর্তনযোগ্যতা ৩. পুনরাবৃত্তি। সহজ ভাষায় আমরা জানি না যে কে ক্ষমতায় আসবে, নির্বাচনে একবার তা নির্ধারিত হলে সেটি বদলে ফেলা যায় না এবং এই যে চক্র-অনিশ্চয়তা এবং ফলাফল গ্রহণের প্রক্রিয়া, তা চলতেই থাকে।

রবার্ট ডাল-এর মতে, কোনো ব্যবস্থাকে ‘গণতান্ত্রিক’ হতে হলে তার সাতটি পূর্বশর্ত থাকতে হবে। নির্বাচিত কর্মকর্তারা, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, সর্বজনীন ভোটাধিকার, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য প্রার্থী হওয়ার অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, তথ্যের বিকল্প উৎস এবং সংগঠন তৈরির স্বাধীনতা। ডাল জোর দিয়ে বলেছেন যে গণতন্ত্রের জন্য ‘শুধু অবাধ, সুষ্ঠু ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনই নয়, বরং এগুলোকে সত্যিকারভাবেই অর্থপূর্ণ করে তোলার মতো স্বাধীনতাও প্রয়োজন (যেমন সংগঠন গড়ে তোলার স্বাধীনতা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা)। প্রয়োজন তথ্যের বিকল্প উৎস এবং নাগরিকদের ভোট ও পছন্দের ওপর ভিত্তি করে সরকারি নীতিমালা প্রণয়নের নিশ্চয়তা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের।’

এই সব গবেষণার ওপর নির্ভর করে গণতান্ত্রিক শাসনের জন্য তিনটি উপাদানকে অপরিহার্য হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। সেগুলো হচ্ছে ১. সর্বজনীন ভোটাধিকার; ২. আইনসভা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদের জন্য নিয়মিত অবাধ, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক, বহুদলীয় নির্বাচন ৩. নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারগুলোর প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা, যার মধ্যে মতপ্রকাশ, সমাবেশ ও সংগঠন তৈরির স্বাধীনতা অন্তর্ভুক্ত। একই সঙ্গে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা, যার অধীনে সব নাগরিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিরা সত্যিকারের আইনি সম–অধিকার ভোগ করবেন। কোনো দেশকে গণতান্ত্রিক হিসেবে স্বীকৃতি পেতে হলে তার এই তিনটি মানদণ্ডেই উতরাতে হবে। কারণ, এর যেকোনো একটি অনুপস্থিত হলেই অন্যগুলোর উপস্থিতি প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।

গত কয়েক দশকে যেটা সহজেই লক্ষ করা গেছে, তা হলো, দেশে দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। গণতন্ত্রায়ণের বিভিন্ন পর্যায়ে নির্বাচনের ওপর এতটাই জোর দেওয়া হয়েছে যে অনেক অগণতান্ত্রিক দেশ ১৯৯০-এর দশক থেকে নিয়মিতভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান করে দেখাতে চায় যে তারা গণতন্ত্রের চর্চা করছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যামুয়েল হান্টিংটন নির্বাচনকে গণতন্ত্র সংহত হওয়া না হওয়ার পরীক্ষা হিসেবেই দেখিয়েছিলেন। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, একটি দেশের গণতন্ত্র স্থায়ী রূপ নিয়েছে কি না, সেটা বোঝা যাবে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে ওই
দেশ পরপর দুটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করতে পারছে কি না, যাতে ক্ষমতার হাতবদল হয়েছে। তাঁর ভাষায়, এটি হচ্ছে ‘টু টার্নওভার টেস্ট’ (দুবার হাতবদলের পরীক্ষা)। পরাজিতরা ফলাফল মেনে নিয়েছে কি না এবং বিজয়ীরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও প্রতিষ্ঠানকে পাল্টে দিয়ে কর্তৃত্ববাদী শাসনের সূচনা করেছে কি না, সেটা গণতন্ত্রায়ণের নির্ধারক পরীক্ষা।

সবার জন্য আইনিভাবে ভোটাধিকার নিশ্চিত করা এবং নিয়মিতভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান আপাতদৃষ্টে গণতন্ত্রের দুটি আবশ্যকীয় শর্ত পূরণ করলেও নির্বাচন যদি অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক না হয়, তবে সেগুলো আসলে দেশকে গণতন্ত্রের পথে তো অগ্রসর করেই না, বরং উল্টো পথে ঠেলে দেয়। দেখা দরকার যে এই সব নির্বাচন গণতন্ত্রকে সংহত করার বদলে ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতাকে আরও সংহত করে কি না। নির্বাচনে জালিয়াতির বিভিন্ন ধরনের উপায় এই সব ক্ষমতাসীন বের করেছেন, যেগুলোর কিছু প্রত্যক্ষ আর কিছু হচ্ছে পরোক্ষ। এটাও মনে রাখা দরকার যে নির্বাচন এক দিনের বিষয় নয়, ভোটাররা এক দিন ভোট দেন, কিন্তু নির্বাচনের প্রস্তুতি ও পদক্ষেপ নেওয়া হয় আরও অনেক আগে থেকেই। সেগুলোর মাধ্যমে আগে থেকেই ফল প্রভাবিত করার ব্যবস্থা করা হলে নির্বাচনের দিন কী হলো, তার কোনো মূল্য থাকে না, ভোটাররা তখন নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী হন না। নাগরিকদের অধিকার—কথা বলার, মতপ্রকাশের, সমাবেশের এবং সর্বোপরি এই সবের কারণে আইনি এবং বিচারবহির্ভূতভাবে লাঞ্ছিত না হওয়ার নিশ্চয়তা হচ্ছে গণতন্ত্রের অত্যাবশ্যকীয় বিষয়।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই তিনটি লক্ষণ কী অবস্থায় আছে, তা নাগরিকেরা সহজেই উপলব্ধি করতে পারেন। ফ্রিডম হাউসের ২০২১ সালের প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের অবস্থান গত বছরগুলোতে ক্রমাগতভাবে খারাপ হয়েছে; মোট স্কোর ২০২১ সালের প্রতিবেদনে দাঁড়িয়েছে ৩৯, যা ২০২০ সালের প্রতিবেদনের স্কোরের সমান; ২০১৯ সালে ছিল ৪১ এবং ২০১৮ সালের প্রতিবেদনে এই স্কোর ছিল ৪৫। একইভাবে রাজনৈতিক অধিকার এবং নাগরিক স্বাধীনতা ক্রমাগতভাবে নিম্নগামী হয়েছে। রাজনৈতিক অধিকারের জন্য বরাদ্দ সর্বোচ্চ ৪০-এর মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর ১৫, যা ২০১৬ সালেও ছিল ২১। ফ্রিডম হাউস বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থাকে ‘আংশিক মুক্ত’ বলে বর্ণনা করেছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কতটা সীমিত, তা বোঝা যায় ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের ব্যবহার থেকে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই আইনের আওতায় ৮৭৩ ব্যক্তি অভিযুক্ত হয়েছেন, যাঁদের ১৩ শতাংশের বেশি হচ্ছেন সাংবাদিক।

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Leave a comment
scroll to top