Close

নির্বাচন বাদ দিয়ে যারা শাসন ব্যবস্থার কথা বলেন তাঁরা স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার কথা বলেন

নিশ্চয় ইতিমধ্যেই লক্ষ্য করে থাকবেন যে, রসিকতা করে হলেও অনেকেই লিখছেন এই প্রস্তাবটা খারাপ নয়, এতে করে অনেক টাকা বেঁচে যাবে সেহেতু নির্বাচন করার আর দরকার নেই। তাঁদের অনেকেই যে এই মন্তব্য করছেন গত দুই নির্বাচনে নির্বাচনের নামে যে প্রহসন হয়েছে সেটা বিবেচনা করে। এটি ক্ষোভের এক ধরনের বহিঃপ্রকাশও বটে। কিন্তু এই ধরনের কথাবার্তা নির্বাচনকে ছেলেখেলায় পরিণত করার চেষ্টাকেই সাহায্য করে। এগুলো হচ্ছে বিরাজনীতিকরণের অংশ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আ ক ম জামাল উদ্দীন নির্বাচন ছাড়াই বর্তমান সংসদ ও সরকারের মেয়াদ আরও পাঁচ বছর বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন (প্রথম আলো, ২২ মে ২০২৩)। এই প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির একটি কর্মসূচিতে। এই কর্মসূচি ছিল রাজনৈতিক কারণে, ফলে এই ধরনের রাজনৈতিক বিষয়ে বক্তব্যকে হেলাফেলা করে দেয়া বক্তব্য বলে মনে করার কারণ নেই। অধ্যাপক উদ্দীন কতটা পরিচিত সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়, এটি শিক্ষক সমিতির একটি সমাবেশে দেয়া বক্তব্য বলেই এই নিয়ে সংবাদ হয়েছে। এই নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে আলোচনা এবং হাসি-তামাশা হলেও একে হাসি-তামাশার বিষয় মনে করার কারণ নেই। দুটি কারণে এই বক্তব্য আমাদের মনোযোগ দাবি করে। প্রথমত ঐতিহাসিক, দ্বিতীয়ত এর উদ্দেশ্য।

ঐতিহাসিক কারণ সুবিদিত। বাংলাদেশ সংবিধান সংশোধন করে নির্বাচিত সংসদের মেয়াদ বাড়িয়ে নেয়ার ঘটনা আগে ঘটেছে। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি তৎকালীন জাতীয় সংসদে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী, যা দেশে একদলীয় প্রেসিডেন্ট শাসিত বাকশাল ব্যবস্থা চালু করেছিলো, সেই সংশোধনীতে ঐ সংসদের মেয়াদ ২৫ জানুয়ারি, ১৯৭৫ তারিখ থেকে আরও পাঁচ বছরের জন্য বাড়ানো হয়। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদ ইতিমধ্যেই প্রায় দুই বছর পার করে ফেলেছিল। তার অর্থ হচ্ছে জনগণের রায়ের বিষয়ে তোয়াক্কা না করে সংসদ সদস্যরা নিজেদের মেয়াদ নিজেরাই ঠিক করেছিলেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভেতরে এই ধরনের চিন্তা আছে কিনা আছে কিনা সেই বিষয়ে আমরা অবগত নই। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের নেতারা এবং তাঁদের অনুসারীরা প্রায়শই সেই সময় ক্ষমতায় থেকে তৈরি করা দল বাকশালের প্রশংসা করে থাকেন।

দ্বিতীয় যে কারণে এই বক্তব্য আমাদের মনোযোগ দাবি করে তা হচ্ছে উদ্দেশ্য। নিশ্চয় ইতিমধ্যেই লক্ষ্য করে থাকবেন যে, রসিকতা করে হলেও অনেকেই লিখছেন এই প্রস্তাবটা খারাপ নয়, এতে করে অনেক টাকা বেঁচে যাবে সেহেতু নির্বাচন করার আর দরকার নেই। তাঁদের অনেকেই যে এই মন্তব্য করছেন গত দুই নির্বাচনে নির্বাচনের নামে যে প্রহসন হয়েছে সেটা বিবেচনা করে। এটি ক্ষোভের এক ধরনের বহিঃপ্রকাশও বটে। কিন্তু এই ধরনের কথাবার্তা নির্বাচনকে ছেলেখেলায় পরিণত করার চেষ্টাকেই সাহায্য করে। এগুলো হচ্ছে বিরাজনীতিকরণের অংশ। ইতিমধ্যে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেবার পরে এই ধরনের আলোচনা ভয়াবহ অবস্থার ইঙ্গিত দেয়। ক্ষমতাসীনরা যেহেতু এতে লাভবান হবেন তাঁরাও চান যে মানুষ নির্বাচন নিয়েই অনাগ্রহী হয়ে উঠুক, নির্বাচন হাসি-তামাশার বিষয়ে পরিণত হোক। আপনি-আমি এই ধরনের উদ্দেশ্যের অংশ হয়ে উঠছি কিনা সেটা ভেবে দেখা দরকার।

বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নির্বাচন না হবার এক কৌশল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে গত এক দশকে। নির্বাচন বাদ দিয়ে যারা শাসন ব্যবস্থার কথা বলেন তাঁরা গণতান্ত্রিক শাসনের কথা বলেন না, তাঁরা বলেন স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার কথা। মনে রাখবেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক ২০১৪ সালের নির্বাচনের পরপরই দেশে পরবর্তী নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত ‘গণতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার আহবান জানিয়েছিলেন। এরপরের ইতিহাস আমাদের সকলের জ্ঞাত বলে পুনরুল্লেখ বাহুল্য মাত্র।

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Leave a comment
scroll to top