Close

বাংলাদেশের নীরবে স্বৈরতন্ত্রে যাত্রা : গণতান্ত্রিক সাফল্যের সমাপ্তি

বাংলাদেশের গণতন্ত্র থেকে পশ্চাদপসরণ ঘটেছে অত্যন্ত দ্রুত। ইতিমধ্যেই, সরকার ক্রমবর্ধমানভাবে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ক্ষমতার প্রয়োগ করেছ, বিরোধীরা ভীত এবং বিভক্ত, বিচার ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে আপস করছে এবং সুশীল সমাজ ম্লান হয়ে গেছে। গণতন্ত্রের এই অবক্ষয় বন্ধ না হলে বাংলাদেশ কার্যত একদলীয় স্বৈরাচারী রাষ্ট্রে পরিণত হবে। দুর্ভাগ্যবশত, দুর্যোগ এড়াতে দেশটির ভেতরে বা বাইরে স্বল্পসংখ্যক শক্তিই কিছু করতে ইচ্ছুক বা সক্ষম বলে মনে হচ্ছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দৃশ্যত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, প্রতিবেশী মিয়ানমার থেকে আসা ১০ লাখেরও বেশি শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য তার মানবিক প্রচেষ্টা এবং আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনের সাথে যুক্ত ইসলামপন্থী জঙ্গি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য বাংলাদেশ প্রায়শই সারা বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণ করে আসছে। একে দেখানো হয়েছে উদারীকরণ এবং বিশ্বায়নের সাফল্য হিসেবে। বিশ্বের অষ্টম জনবহুল দেশটি ৯০-এর দশকে সামরিক শাসন থেকে নির্বাচনী গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করে। ২০০৬ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে দেশটি সফলভাবে দেড় কোটি মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বের করে এনেছে। ২০০০ সালের পর থেকে সামগ্রিক দারিদ্র্যের হার অর্ধেকে কমিয়ে এনেছে। দেশটির ম্যানুফাকচারিং খাত এবং বস্ত্র খাত প্রভূত উন্নতি করেছে। নারীদের কর্মসংস্থান এবং আয়ুষ্কাল বৃদ্ধির মতো বহু গুরুত্বপূর্ণ মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ প্রতিবেশী ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে। দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মাঝখানে অবস্থিত এই দেশটির ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বও ক্রমবর্ধমান।

কিন্তু এই আশাব্যঞ্জক কাহিনীর ব্যাপারে থেকে সতর্ক থাকবার প্রচুর কারণ রয়েছে। অর্থনীতিবিদরা জিডিপি বৃদ্ধির প্রকৃত হার (যেটি সরকারি পরিসংখ্যানের চেয়ে কম হতে পারে) এবং উন্নয়ন নীতির ফলে দেশে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করলে আরও নৈরাশ্যজনক চিত্রই দেখতে পাওয়া যায়। প্রায় ১৪ বছর ধরে দেশ শাসন করা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে বাংলাদেশ কর্তৃত্ববাদের দিকে ধাবিত হচ্ছে। ২০২১ সালে গণতন্ত্র বিষয়ক গবেষণা সংস্থা ভি-ডেম ইন্সটিটিউট, হাঙ্গেরি, ভারত, তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্য দেশগুলোর পাশাপাশি বাংলাদেশকেও সেই গণতন্ত্রের উদাহরণ হিসেবে তালিকাবদ্ধ করে যেগুলোতে “স্বৈরাচারীকরণ” হচ্ছে। কর্তৃত্ববাদের কিছু ক্লাসিক চিহ্ন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সহজেই দেখা যায়: শেখ হাসিনার হাতে ক্ষমতা ক্রমবর্ধমানভাবে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে, সংসদে ক্ষমতাসীন দলের আধিপত্য রয়েছে। দলটি বেসামরিক প্রশাসন এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর উপরও দৃঢ় দখল প্রতিষ্ঠা করেছে।

বাংলাদেশের গণতন্ত্র থেকে পশ্চাদপসরণ ঘটেছে অত্যন্ত দ্রুত। ইতিমধ্যেই, সরকার ক্রমবর্ধমানভাবে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ক্ষমতার প্রয়োগ করেছ, বিরোধীরা ভীত এবং বিভক্ত, বিচার ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে আপস করছে এবং সুশীল সমাজ ম্লান হয়ে গেছে। গণতন্ত্রের এই অবক্ষয় বন্ধ না হলে বাংলাদেশ কার্যত একদলীয় স্বৈরাচারী রাষ্ট্রে পরিণত হবে। দুর্ভাগ্যবশত, দুর্যোগ এড়াতে দেশটির ভেতরে বা বাইরে স্বল্পসংখ্যক শক্তিই কিছু করতে ইচ্ছুক বা সক্ষম বলে মনে হচ্ছে।

গণতান্ত্রিক সূচনা

১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে মুক্ত হওয়ার পর, ১৯৭৫ সালে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসে। ১৯৮২ সাল থেকে দেশ শাসন করে আসা পশ্চিমাপন্থী জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগ পর্যন্ত জেনারেলরাই কার্যত দেশ শাসন করছিলেন। পরবর্তী নির্বাচনী প্রচারণায়, দুটি দল শক্তিশালী হিসেবে আবির্ভূত হয়: বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতির কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মধ্যপন্থী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, এবং আরেক সাবেক রাষ্ট্রপতির বিধবা স্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে মধ্য ডানপন্থী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল। ১৯৯১ সালের ভোটে বিএনপি জয়লাভ করে। কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা থেকে আরও জবাবদিহিমূলক সংসদীয় ব্যবস্থায় রূপান্তরের সময় খালেদা জিয়া রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন।

ফলে অপেক্ষাকৃত সুস্থ নির্বাচনী গণতন্ত্রের যুগের সূচনা হয়, যাতে ছিল নিয়মিত অবাধ নির্বাচন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সমাবেশের উপর স্বল্প পরিসরে বিধিনিষেধ, প্রাণবন্ত নাগরিক সমাজ এবং স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা। নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং মানবাধিকার কমিশনসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান দুর্বলই রয়ে যায়। কিন্তু নির্বাচনের মাধ্যমে ‘চেক এন্ড ব্যালেন্সের’ একটি কার্যকর ব্যবস্থা ছিল এবং রাজনীতিতে নাগরিকদের অংশগ্রহণ সর্বকালের মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল।

প্রধান পদ্ধতিগত বিরোধসমূহ মোকাবেলার ক্ষেত্রে সিস্টেমটি ভালোই চলছিল। ১৯৯৬ সালের সংসদীয় নির্বাচনের আগে সারা দেশে বিক্ষোভ করে আওয়ামী লীগের সমর্থকরা সতর্ক করে যে বিএনপির দ্বারা পরিচালিত নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। ওই বিক্ষোভ কাজে দিয়েছিল: পরবর্তীকালে সংসদ দেশের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে নির্দলীয় মন্ত্রীসভা নিয়ে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার, যা সংসদ ভেঙে দেওয়া এবং পরবর্তী সংসদ গঠনের মধ্যবর্তী সময়ে নির্বাচন তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পালন করবে, প্রতিষ্ঠার জন্য সংবিধান সংশোধন করে। নতুন এই সাংবিধানিক বিধানটি প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোকে সন্তুষ্ট করেছিল৷ এ পদ্ধতিতে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে পরপর দুটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ দুই দলই পালা করে ক্ষমতায় এসেছিল।

কিন্তু এরপরই বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ক্ষতিটা শুরু হয়। প্রধান দুটি দলের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে, বিশেষ করে ২০০৪ সালের পরে যখন ইসলামপন্থী জঙ্গি গোষ্ঠী হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করে, যার প্রতি বিএনপি সরকারের অভ্যন্তর থেকে মৌন সমর্থন ছিলো, এবং তারপর বিএনপি সরকার কর্তৃক সেটা ধামাচাপা দেওয়ার বাজে প্রচেষ্টা চালিয়েছিল৷ সেই বছরই, বিএনপি সংবিধান সংশোধন করে যাতে দলের প্রতি সহানুভূতিশীল জনৈক সাবেক প্রধান বিচারপতিকে পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান পদে স্থান দেওয়া যায়। এই পদক্ষেপ সংঘাত ও সহিংসতা, কঠোর সরকারী দমন-পীড়ন এবং বিশাল রাজনৈতিক অচলাবস্থার জন্ম দেয় যার ফলে ২০০৭ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে দেশকে বেসামরিক সরকারের ছদ্মবেশে সামরিক শাসন জারি থাকে। আন্তর্জাতিক চাপ এবং অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার কারণে ঐ সরকার ২০০৮ সালে নির্বাচন দিতে বাধ্য করে। তাতে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হলে হাসিনা দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসেন। অনেক বাংলাদেশি আশা করেছিলেন, স্বল্প সময়ের ওই সামরিক শাসনের অবসান দেশের গণতান্ত্রিক সম্ভাবনাকে পুনরুজ্জীবিত করবে। কিন্তু ঘটলো তার উল্টোটা।

পশ্চাদপসরণ

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থা নষ্ট হয়ে যাওয়াটা কর্তৃত্ববাদের দিকে যাত্রাকে উৎসাহিত করে। বিপুল সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার সাহসে বলীয়ান হয়ে আওয়ামী লীগ ২০১১ সালে সংবিধানে থাকা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তার আধিপত্য সুরক্ষিত করার জন্য এই পদক্ষেপ নিয়েছিলো, আওয়ামী লীগের নেতারা বিএনপিকে প্রচণ্ডভাবে অবিশ্বাস করতেন। এই সংশোধনী ক্ষমতাসীনদের সংসদীয় নির্বাচন তত্ত্বাবধান-এবং সম্ভাব্য কারচুপি করার সুযোগ দেওয়ার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক রক্ষাকবচকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এই পথ থেকে শেখ হাসিনার সরকারকে সরে আসতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের, বিশেষ করে জাতিসংঘের মধ্যস্থতাকারীদের প্রচেষ্টাকে তিনি উপেক্ষা করেন। বিএনপির নেতৃত্বে বিরোধী পক্ষ, ওই বিধান পুনর্বহালের দাবি জানায় এবং ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত পরবর্তী নির্বাচন বয়কট করে। ফলস্বরূপ, তখন থেকেই আওয়ামী লীগ সংসদে আধিপত্য বিস্তার করে ।

পরবর্তী বছরগুলোতে, দলটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও চর্চার নিরবচ্ছিন্ন ক্ষতি করেছে। বিচার বিভাগ এখন আর আগের সেই স্বাধীনতা ভোগ করে না। ২০১৪ সালের একটি সাংবিধানিক সংশোধনীতে সংসদ কর্তৃক বিচারকদের অভিশংসনের ক্ষমতা দেওয়া হয়। এর ফলে বিচার বিভাগ দলীয় প্রভাব দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার ব্যাপারে আরও দুর্বল হয়ে পড়ে।

সুশীল সমাজের কথা বলার জায়গা যথেষ্ট সংকুচিত হয়ে গেছে। ২০১৬ সালের এক আইনের মাধ্যমে বেসরকারি সংস্থাগুলোর দেশের বাইরের উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ করার সুযোগ সীমিত করা হয়েছে। এই পদক্ষেপ কার্যকরভাবে স্বাধীন সুশীল সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করার অস্ত্র হয়ে উঠেছে। দেশটিতে ছিলো সক্রিয় নাগরিক সমিতি এবং সামাজিক উন্নয়নে যুক্ত বেসরকারি সংস্থাগুলোর দীর্ঘ ঐতিহ্য, যা সামগ্রিকভাবে নাগরিকদের সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সম্পৃক্ত হতে উৎসাহ দিতো। ১৯৮০’র দশকে নির্দলীয় পেশাজীবী সংগঠনগুলো গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল এবং বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন ২০০২ সালে আবির্ভূত হয়েছিল যারা সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচনের জন্য চাপ দিয়েছিল। এই সবই সুশীল সমাজ শক্তিশালীকরণে ভূমিকা রেখেছিল। দেশের একসময়ের প্রাণবন্ত সুশীল সমাজ এখন তার ছায়ায় পরিণত হয়েছে। এখন, ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকরা এসব সুশীল সমাজের সংগঠনের বুদ্ধিজীবী এবং নেতৃত্বকে অপমান করে, যার মধ্যে রয়েছে বিরোধী কণ্ঠকে লক্ষ্য করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানুষকে বিক্ষুব্ধ করে তোলা। ২০১৮ সালে পার্লামেন্টে এমন একটি কঠোর আইন পাস করা হয়েছে যা সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠ স্তব্ধ করেছে এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ব্যাপকভাবে সীমিত করেছে। আইনটি চালু হওয়ার পর থেকে কর্তৃপক্ষ আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করা কিংবা ইন্টারনেটে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের মানহানি করার অভিযোগে ২,৫০০ জনেরও বেশি মানুষের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে। সরকার নির্বিচারভাবে আইনি এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে ফোনে আড়িপাতায় লিপ্ত হয়েছে, যার ফলে সন্দেহের জন্ম হয়েছে যে, ব্যাপক নজরদারি করা হচ্ছে।

সমাজে ভয়ের সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়েছে। বিরোধীদের জনসভা করার অনুমতি না দেয়া এবং বিক্ষোভকারীদের একত্রিত হলে তাদের উপর বারবার হামলা করার মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ সংবিধানে বর্ণিত সমাবেশ করার মৌলিক অধিকারকে কঠোরভাবে সীমিত করেছে। সরকারকে চ্যালেঞ্জ করা থেকে বিরত রাখতে বিরোধী দলগুলো বিশেষ করে বিএনপির নেতা-কর্মীরা অযৌক্তিক অভিযোগের সম্মুখীন হন। কিন্তু এ ধরনের পদক্ষেপ শুধু দলীয় রাজনৈতিক কর্মীদের লক্ষ্য করেই নেওয়া হয়না; পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের সশস্ত্র সমর্থকরা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছে যারা শুধুমাত্র সড়কে নিরাপত্তার দাবি তুলেছিল। আরও খারাপ হলো, প্রাক্তন কূটনীতিক, শিক্ষাবিদ এবং বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের ব্যক্তিদের বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং গুম করার কাজে সরকার জড়িত রয়েছে।

ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবেই আওয়ামী লীগ নিজ ক্ষমতা মজবুত করেছে। ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে বেসামরিক প্রশাসনের উপর দলটির নিয়ন্ত্রণ এতটাই নিরঙ্কুশ ছিল যে দল, সরকার এবং রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য ছিল না।

সরকারের প্রভাবিত নির্বাচন কমিশন, সরকারপন্থী গোষ্ঠীগুলো দ্বারা বেপরোয়া সহিংসতা এবং বিরোধী কর্মীদের বিরুদ্ধে অসংখ্য ভিত্তিহীন অভিযোগ দায়েরকারী ও আওয়ামী লীগের সমর্থকদের আক্রমণের সময় নীরব আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পক্ষপাতমূলক ভূমিকার মুখোমুখি কারণে নবগঠিত বিরোধীদলীয় জোটের কোনও সুযোগ ছিল না। ক্ষমতাসীন দল এবং তার মিত্ররা সংসদে ৩০০ টি আসনের মধ্যে ২৮৮ টি আসনে জয়লাভ করে। মিডিয়া রিপোর্ট বলছে, ‘ব্যালট বাক্স ভর্তি করা এবং ফলাফলে ব্যাপক কারচুপি (কিছু ক্ষেত্রে, এমনকি মৃত ব্যক্তি ভোট দিয়েছেন এমনটাও রেকর্ড করা হয়েছে) এই ধরনের একতরফা বিজয় নিশ্চিতে সাহায্য করেছে। ২০১৮ সালের নির্বাচন নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা ভেঙ্গে দিয়েছে, যার ফলে এরপরের সমস্ত স্থানীয় এবং উপ-নির্বাচনগুলোতে ভোটারদের উপস্থিতি খুবই কম ছিল।

ক্ষমতাসীন দলের ক্রিয়াকলাপ গণতন্ত্রের নিম্নগামী হওয়াকে ত্বরান্বিত করেছে, তবে বিরোধীরা সেটা বন্ধ করতে পারেনি। ২০১৫ সালে, বিএনপি হিংসাত্মক বিক্ষোভ শুরু করে যার চরম মূল্য দলটিকে দিতে হচ্ছে। এর ফলে সরকার প্রচণ্ডভাবে দমন-পীড়নের অজুহাত পায়। ওই আন্দোলন দলটিকে বিচ্ছিন্নও করে তুলে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বিএনপির প্রধান খালেদা জিয়া ২০১৮ সালে দুর্নীতির সন্দেহজনক অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হন এবং ১৭ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। বিএনপি জোর দিয়ে বলে যে অভিযোগগুলো ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, যাতে তাকে রাজনীতি থেকে বিরত রাখা যায় এবং তার দলকে দুর্বল করা যায়। তিনি দুই বছরের বেশি জেলে থাকার পর, অসুস্থতার কারণে ২০২১ সালে তার সাজা সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়। খালেদা জিয়ার অবস্থার অবনতি হয়েছে৷ তার চিকিৎসকদের আশংকা বিদেশে চিকিৎসা না নিলে তার প্রাণনাশ হতে পারে। কিন্তু, সরকার তাকে যেতে দেয়নি। অভ্যন্তরীণ কোন্দলও বিএনপিকে দুর্বল করেছে। আপাতদৃষ্টিতে খালেদা জিয়ার উত্তরাধিকারী তারেক রহমান লন্ডনে নির্বাসন থেকে দলকে নেতৃত্ব দিতে সাহায্য করছেন। তিনি শুধু দুর্নীতির দায়েই দোষী সাব্যস্ত হননি, ২০০৪ সালে শেখ হাসিনার ওপর হামলায় ভূমিকা রাখার জন্য তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডও দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগকে সত্যিকারের চ্যালেঞ্জ জানাতে দলটি শীঘ্রই যে কোনো সময় ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হবে বলে মনে হয় না।

মূল্যবোধের চেয়ে স্বার্থই বড়

এতসব উদ্বেগজনক ঘটনা সত্ত্বেও বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের পশ্চাদপসরণ নিয়ে আলোচনার সময় বাংলাদেশের নাম খুব কমই উচ্চারিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো দক্ষিণ এশিয়া থেকে সম্ভাব্য সন্ত্রাসী হুমকি মোকাবিলায় প্রধানত শক্তিশালী নিরাপত্তা সম্পর্ক বজায় রাখার নীতিকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। তারা শেখ হাসিনা সরকারকে পথ পরিবর্তনে উৎসাহিত করার পরিবর্তে বরং তাকে সমর্থনই করেছে।

এই নীতিটি এখনও অব্যাহত রয়েছে। তবে বাইডেন প্রশাসনকে এই কৃতিত্ব দিতে হবে যে, তাঁরা এতে কিছু পরিবর্তন আনতে শুরু করে করেছে। বাংলাদেশের সাথে লেনদেনের ক্ষেত্রে এটি নিজের বৈদেশিক নীতির স্তম্ভ হিসেবে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছে। গত ডিসেম্বরে হোয়াইট হাউসের গণতন্ত্র শীর্ষ সম্মেলন থেকে বাংলাদেশকে বাদ দিয়ে এবং একই মাসে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত পুলিশের বিশেষ ইউনিট র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের সাতজন বর্তমান ও প্রাক্তন কর্মকর্তার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে ওয়াশিংটন ঢাকায় একটি সুনির্দিষ্ট বার্তা পাঠিয়েছে।

তবে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শেখ হাসিনা সরকার যৎসামান্য বাইরের চাপের সম্মুখীন হয়ে থাকে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অধীনে নিজস্ব গণতন্ত্রের অবনতি হওয়া ভারত নিজের কৌশলগত এবং অর্থনৈতিক স্বার্থের কারণে ২০০৯ সাল থেকে শেখ হাসিনা সরকারকে কিছু না ভেবে পুরোপুরি সমর্থন দিয়ে আসছে যার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের বন্দরগুলোতে প্রবেশাধিকার এবং দেশটির মধ্য দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে ট্রানজিট সুবিধা নেওয়া। চীনের কাছে বাংলাদেশ ক্রমবর্ধমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় নিজের প্রভাবের ক্ষেত্র বাড়ানোর জন্য চীনের আগ্রাসী প্রচেষ্টার মধ্যে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি বড় অবকাঠামো প্রকল্পে অর্থায়ন অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আওয়ামী লীগ নিজের অভ্যন্তরীণ অবস্থানকে শক্ত করার জন্য এসব ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতাকে বেশ চাতুর্যের সাথে ব্যবহার করেছে।

মূলত নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণেও বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অবস্থা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে উপেক্ষিত হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশের আল কায়েদা এবং তথাকথিত ইসলামিক স্টেটের মতো আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো ২০১৩ সাল থেকে দেশে আরও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে৷ ২০১৬ সালে রাজধানী ঢাকার একটি ক্যাফেতে সন্ত্রাসী হামলা বিশ্বব্যাপী দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। পশ্চিমা দেশগুলো সেই থেকে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অবক্ষয় রোধের চেয়ে নিরাপত্তা সহযোগিতাকে বেশি অগ্রাধিকার দিয়েছে।

তারা প্রতিবেশী মিয়ানমার থেকে আসা দশ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ার চাপ মোকাবিলা করতে বাংলাদেশকে সমর্থনেরও চেষ্টা করেছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং পশ্চিমা সরকারগুলো এসব শরণার্থীদের ফেরাতে মিয়ানমারকে বাধ্য করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের ক্যাম্পগুলোতে প্রায়শ্চিত্ত করার বাইরে কয়েকটি বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছে।

গণতন্ত্রকে সমর্থন করতে পশ্চিমা সরকারগুলোর দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়ার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ন্যায্যতা হয়ে উঠেছে রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট; তারা আর রোহিঙ্গাদের দায়িত্ব নিচ্ছে না এবং এই সংকট মোকাবিলার ভার বাংলাদেশের কাঁধে ছেড়ে দিয়েছে। তাই তারা দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংস্কারকে উৎসাহিত করার চেষ্টা করে বাংলাদেশ সরকারকে আর বিরক্ত করতে চায় না।

কিন্তু সম্ভবত শেখ হাসিনা সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হল অর্থনৈতিক; ব্যবসায়িক স্বার্থ গণতন্ত্রের জন্য উদ্বেগকে তুচ্ছ করেছে। গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের শক্তিশালী প্রবৃদ্ধি দেশটিকে আন্তর্জাতিক বেসরকারি বিনিয়োগের নতুন গন্তব্যে পরিণত করেছে। বিদেশী সরকারগুলো শেখ হাসিনার শাসনামলের স্থিতিশীলতাকে প্রশংসা করে। বাংলাদেশ তার সামরিক বাহিনীকে উন্নত করার সাথে সাথে ফ্রান্স, তুরস্ক এবং যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সাথে অস্ত্র চুক্তি করতে চাইছে, যা শেখ হাসিনাকে আরও শক্তিশালী করেছে।

বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচন ২০২৩ সালের শেষের দিকে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে, ফলাফলও একই হওয়ার কথা। চলমান রাজনৈতিক অবস্থা এবং পূর্ববর্তী দুটি সংসদ নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যায় যে, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের সম্ভাবনা নেই। বর্তমান ব্যবস্থা যেখানে ক্ষমতাসীনরা নির্বাচনের তত্ত্বাবধান করেন তার সংস্কার ছাড়া ক্ষমতাসীন দল প্রায় নিশ্চিতভাবেই আবারও বিজয়ী হবে। শেখ হাসিনা সরকার ইতিমধ্যেই তার সমালোচকদের দমন করে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সহ সাইবারস্পেসে ক্র্যাক ডাউন চালিয়ে এবং তৃণমূল কর্মীদের বিরুদ্ধে নতুন নতুন মামলা দায়ের করে, জনসমাবেশ নিষিদ্ধ করে বিরোধী দলগুলোকে আরও দুর্বল করে নিজের অনুকূলে পরিস্থিতি তৈরি করছে। ফেব্রুয়ারিতে নিযুক্ত নতুন নির্বাচন কমিশন ক্ষমতাসীনদের প্রতি অনুগত থাকবে।

দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিরোধীরা সত্যিকারের পরিবর্তন আনতে পারবে এবং ক্ষমতাসীন দল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও নিয়ম-কানুনকে শক্তিশালী করার নামে নিজেদের দুর্বল করে ফেলবে বলে মনে হয় না। দেশের গণতন্ত্র ক্ষয় শ্লথ হবে না যতক্ষণ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে, শেখ হাসিনা সরকারকে স্পষ্ট করে দেবে যে কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই গণতান্ত্রিক সুযোগের দ্বার উন্মুক্ত করে দিতে হবে, নিয়ন্ত্রণমূলক কঠোর আইন বাতিল করতে হবে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে জবাবদিহি করতে হবে এবং নাগরিকদের ফের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের অনুমতি দিতে হবে। এসব পরিবর্তন ছাড়া, বাংলাদেশিদের আগামী বছরের নির্বাচনের ফলাফলের উপর আস্থা রাখার তেমন কোন কারণ থাকবে না এবং দেশটি স্বৈরতন্ত্রের দিকে ধাবিত হবে।

  • অনুবাদ করেছেন তারিক চয়ন

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Leave a comment
scroll to top