বাংলাদেশ বিষয়ে দেশের বাইরে যে আগ্রহ তৈরি হয়েছে সেটা আমরা সকলেই জানি। তা কেবল এই কারণে নয় যে, বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বেড়েছে এবং এশিয় ও দক্ষিণ এশিয় অঞ্চল বৈশ্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এগুলো বাংলাদেশ বিষয়ে উদ্যোগ, উৎসাহ ও আগ্রহের অন্যতম কারণ। কিন্তু আরও কারণ আছে। বাংলাদেশ বিষয়ে দেশে এবং দেশের বাইরের মানুষের মধ্যে যে আগ্রহ, উৎসাহ তৈরি হয়েছে তার একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনাময় রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সেই সম্ভাবনা তৈরি করেছেন বাংলাদেশের মানুষ – তাঁদের সৃজনশীলতা দিয়ে, তাঁদের অপরিমেয় শক্তি দিয়ে, তাঁদের রিজিলিয়েন্সের ক্যাপাসিটি দিয়ে। যে কোন ধরনের প্রতিকূলতা মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মানুষ অভাবনীয় শক্তি দেখিয়েছেন, তা কেবল রাজনৈতিক নয়, প্রাকৃতিক নয়, অর্থনৈতিক প্রতিকূল পরিবেশ নয়। সম্মিলিতভাবেই মানুষ বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে বাংলাদেশকে একটি সম্ভাবনাময় রাষ্ট্র হিসেবে তৈরি করেছে।
কিন্তু আমরা জানি যে, কোনো দেশ বা রাষ্ট্রের জন্যে সম্ভাবনাই শেষ কথা নয়, সম্ভাবনা কেবল সূচনা। মানব সভ্যতার ইতিহাসে দেখা যায় এবং সমাজবিজ্ঞানীরা যা আমাদের বারবার আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন তা হলো, সম্ভাবনা সর্বক্ষেত্রেই বাস্তবায়িত হয়নি, অনেক ক্ষেত্রেই পথভ্রষ্ট হয়েছে। সমাজবিজ্ঞানীরা এটাও আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন যে, সম্ভাবনার বাস্তবায়নের জন্যে প্রয়োজন কেবল ব্যক্তি নন, প্রয়োজন হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের; প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সংগঠিত থাকা, শক্তি সঞ্চয় করা অত্যন্ত জরুরি।
বাংলাদেশের অপরিমেয় সম্ভাবনার কথা আজকেই শুধু বলা হচ্ছে তা নয়। সেই সম্ভাবনা বাস্তবায়িত হবে কিনা সেটা নির্ভর করছে অগ্রসর হবার জন্য বাংলাদেশ সঠিক পথ খুঁজে পাচ্ছে কি পাচ্ছেনা তার ওপরে। সেই সম্ভাবনাগুলো বাস্তবায়নের জন্যে, পথ খুঁজে বের করার জন্য যা দরকার তা হচ্ছে বিভিন্ন মত ও পথকে বিচার করা, বিবেচনা করা, আস্থার মধ্যে নেয়া এবং সেগুলোর মধ্যে আলাপ-আলোচনার পথ তৈরি করা। বাংলাদেশের গত ৫০ বছরের পথ পরিক্রমা বলে যে, সেই পথ বিভিন্ন সময়ে সংকুচিত হয়েছে এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখন আরও সংকুচিত হয়ে পড়ছে।
অথচ বাংলাদেশের ইতিহাসের দিকে যদি তাকাই, যদি আমরা তিরিশের দশকের ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’-এর দিকে তাকাই, ষাটের দশকের বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের দিকে যদি আমরা তাকাই তবে দেখবো সব মত ও পথের মধ্যে বিতর্ক, স্বাধীনভাবে চিন্তার করার চেষ্টা দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে। মত ও পথের বিতর্কের চেষ্টাই হচ্ছে অগ্রসর হবার উপায়। তিরিশের দশকের ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’ একটি পথের দিশা দিয়েছিল। ষাটের দশকের সাংস্কৃতিক আন্দোলন একটি পথের দিশা দিয়েছিলো। নব্বইয়ের দশকেও এটা আমরা লক্ষ্য করি যে, বাংলাদেশের বিভিন্ন মত ও পথের মধ্যে আলাপ-আলোচনা, বিতর্ক প্রচলিত ছিলো। কিন্তু গত এক দশকের কিছু বেশি সময় ধরে আমরা দেখতে পাচ্ছি মত প্রকাশের, চিন্তার স্বাধীনতার জায়গাগুলো ক্রমাগতভাবে ছোট হয়ে আসছে।
বাংলাদেশে যে শাসন ব্যবস্থা এবং রাষ্ট্র কাঠামো তৈরি হচ্ছে তাঁর ভিত্তি অংশীদারিত্বের নয়। অথচ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় প্রতিশ্রুতি ছিলো একটি অংশীদারিত্বশীল ব্যবস্থা তৈরি করা। উপরন্তু আজকে আমরা দেখতে পাই তা হচ্ছে আইন ও আইন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মতপ্রকাশ ও চিন্তার স্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে। সমাজে ক্রমাগতভাবেই সহিষ্ণুতা কমে আসছে। রাষ্ট্র ও সরকার সকলের কথা শুনতে আগ্রহী নয়; বরঞ্চ ভিন্নমত অপরাধ বলে বিবেচিত হচ্ছে। এগুলো বাংলাদেশের যে সম্ভাবনার কথা আমরা বলি সেগুলিকে ছোট করে আনে এবং প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে।
ইতিহাস অবশ্যই একটি জাতির অগ্রসর হবার পথের উপকরণ। কিন্তু ইতিহাসের একটি পর্ব, একটি পাঠ, একটি ব্যাখ্যাই যথেষ্ট বা চূড়ান্ত নয়। একটি জাতি যতই পরিণত হয়ে ততই ইতিহাসের নতুন নতুন পাঠ গ্রহণ করে। একইভাবে আমরা এটাও বলতে পারি, শাসন ব্যবস্থা ও অর্থনীতির নীতি নির্ধারণের বিষয় কোনো গোষ্ঠীগত বিষয় নয়, এগুলো সকলের বিষয়, নাগরিকদের বিষয়। সে কারণেই আমরা বিভিন্ন মত ও পথ নিয়ে আলোচনা বিতর্কের তাগিদ অনুভব করি। ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজের কাজ হচ্ছে সেই প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা, সেই প্রতিশ্রুতি দিয়েই ফোরামের তৈরি হচ্ছে। সে জন্যে যা দরকার তা হল, দেশে এবং দেশের বাইরে যেসব বড় ধরণের ব্যত্যয় দেখতে পাচ্ছি সেগুলোকে মোকাবেলা করা। এই ব্যত্যয়ের কারণেই দেশের গণমাধ্যমগুলোতে আলোচনার ক্ষেত্রে এক ধরনের সীমাবদ্ধতা সহজেই দৃশ্যমান। সে সীমাবদ্ধতা অতিক্রমের উপায় হচ্ছে আরও নতুন নতুন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা যেখানে এইসব ব্যত্যয় নিয়ে কথা বলা যাবে।
ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ সমসাময়িক বিষয়গুলো নিয়ে একাডেমিক ও নীতি-নির্ধারকের মতামত তুলে ধরার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। কিন্তু সেটা কেবল এই ফোরামের কাজ নয় – সকল ধরনের সংগঠনেরই কাজ। নীতি নির্ধারণ বিষয়ে আলোচনা করা, নীতি নির্ধারকদের প্রশ্ন করা। সিভিল সোসাইটি বলতে যা বোঝায় এটা তাদেরই কাজ। গণমাধ্যম সেই সিভিল সোসাইটির অংশ। এমনকি গণমাধ্যমের বাইরে বিভিন্নভাবে যেসব সামাজিক মাধ্যম গড়ে উঠছে, বিকশিত হচ্ছে সেগুলোরও এই দায়িত্ব। কিন্তু আমরা দেখতে পাই যে, বিভিন্ন ধরণের বাধা-বিপত্তির কারণে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো সেই দায়িত্ব পালনে হয় অনীহ নতুবা অপারগ।
প্রশ্ন করাই যেতে পারে যে, আলাপ-আলোচনা-বিতর্কের প্রয়োজনে কেন? প্রয়োজন এই কারণে যে, এটা হচ্ছে জবাবদিহিতার একটি পথ। যে কোনো রাষ্ট্রের বিকাশের জন্যে ন্যূনতম দুটি জিনিস দরকার – একটি হচ্ছে অংশীদারিত্ব; অপরটি হচ্ছে জবাবদিহিতা। অংশীদারিত্বের পথ হচ্ছে রাজনীতি ও অর্থনীতিতে অংশগ্রহণের ব্যবস্থা বহাল থাকা, যেন একজন নাগরিক কোনো না কোনোভাবে অংশগ্রহণ করতে পারেন। জবাবদিহিতার একটি অন্যতম দিক হচ্ছে নির্বাচন, সকলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন যেখানে তাঁরা তাঁদের প্রতিনিধিদের নির্বাচন করতে পারবেন, যাদের কাছ থেকে জবাবদিহিতা দাবি করতে পারবেন। কিন্তু যেটা আমরা দেখতে পাচ্ছি তা হল বাংলাদেশে গত দুটি নির্বাচন সেই জবাবদিহিতার উপায় নিঃশেষ করে দিয়েছে।
জবাবদিহিতা হচ্ছে দুই ধরনের; ভার্টিকাল এবং হরাইজেন্টাল একাউন্টেবিলিটি। নির্বাচন এক ধরনের ভার্টিকাল একাউন্টেবিলিটি তৈরি করে। কিন্তু যে কোনা রিপাবলিকের জন্যে, বিশেষ করে যাকে গণতন্ত্র বলে দাবি করা হয় তার জন্যে কেবলমাত্র ভার্টিকাল একাউন্টেবিলিটিই যথেষ্ট নয়, দরকার হচ্ছে হরাইজেন্টাল একাউন্টেবিলিটি। অর্থাৎ সমাজের যে অন্যান্য অংশগুলো আছে, প্রতিষ্ঠানগুলো আছে এবং প্রতিষ্ঠানের বাইরেও যারা আছেন – তাঁরা যেন জবাবদিহিতা দাবি করতে পারেন।
দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে হরাইজেন্টাল একাউন্টেবিলিটির জায়গাগুলো খুব শক্তিশালী হয়নি। ১৯৮০ এবং ১৯৯০ – এর দশকে যে বিভিন্ন ধরণের সিভিল সোসাইটি গড়ে উঠেছিলো এবং বিভিন্ন ধরনের জাবাদিহিতার দাবি তারা তুলছিলেন এবং ক্ষেত্র বিশেষে সফলও হচ্ছিলেন সেগুলো ক্রমাগতভাবে দুর্বল হয়েছে। এই হরাইজেন্টাল একাউন্টেবিলিটির জন্যে আরও দরকার গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকার, চিন্তার ক্ষেত্রে সব ধরণের বাধার অপসারণ। কিন্তু ২০২২ সালের বাংলাদেশে এগুলোর কোনোটিই আছে আমরা এমন দাবি করতে পারি বলে মনে হয়না। একাদিক্রমে সব ধরনের জবাবদিহিতার পথ-পদ্ধতিগুলো দুর্বল হয়েছে এবং ক্ষেত্র বিশেষে অবসিত হয়েছে। এগুলো বাংলাদেশের ভবিষ্যতের শুভ ইঙ্গিত দিচ্ছে না।
এই রকম একটি পরিস্থিতিতেই ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজের যাত্রা শুরু করছে। আরও অনেক ব্যক্তি, গোষ্ঠী, ফোরাম এই লক্ষ্যে কাজ করছে। এই ধরনের চেষ্টা যত বেশি বিস্তার লাভ করবে ততবেশি মানুষ ভিন্ন ভিন্ন মত সম্পর্কে অবহিত হতে পারবেন। এটা আমার কাছে মনে হয় যে, একটি ইতিবাচক দিক।
বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতি বর্তমান সময়ে একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরের মাথায় দাঁড়িয়ে দরকার হচ্ছে গত ৫০ বছরের অর্জনগুলো লক্ষ্য করা, ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো চিহ্নিত করা। ৫০ বছরের মাথায় দাঁড়িয়ে, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পথরেখা কী হবে সেটা নির্ধারণ করার পথে লেখক, একাডেমিক, চিন্তাবিদ ও চিন্তাশীল মানুষ সকলকে সরব হতে হবে, সকলকে অংশগ্রহণ করতে হবে। পরিস্থিতি যতই প্রতিকূল হোক না কেন, এই দায়িত্ব থেকে সরে আসার কোনো উপায় নেই।
সকলের সম্মিলিত চেষ্টার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশে একটি অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। সেই লক্ষ্যে রাজনৈতিক সক্রিয়তার পাশাপাশি দরকার পথ নির্দেশের বিষয়ে আলোচনা করা। ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ সেই আলোচনার প্ল্যাটফর্ম হবে সেটাই প্রত্যাশা।
- ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ –এর উদ্বোধন উপলক্ষে ১০ অক্টোবর ২০২২ আয়োজিত ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তব্যের লিখিত ভাষ্য।