Close

বইমেলায় আদর্শের স্টল না দেয়া সেন্সরশিপ

আমরা এমন এক সময়ে বাস করি, যাকে ‘সহমতের বন্যা প্লাবিত’ বলেই বর্ণনা করা যায়। এই সময়ে জিয়া হাসান ও ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব যে ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন, সেজন্য তাঁদের প্রাপ্য সাধুবাদ—সেন্সরশিপ নয়। তাঁদের মতো যাঁরাই ভিন্নমত প্রকাশ করেন, যুক্তি দিয়ে, তথ্য দিয়ে আমাদের বোঝাতে চান, তাঁদের প্রত্যেকেরই এই সাধুবাদ প্রাপ্য। যাঁরা ‘ভক্তির মোহ আবরণে সত্যকে ঢেকে রাখতে’ চান, তাঁরা যুক্তি দিয়ে এই ভিন্নমতকে মোকাবিলা করতে উৎসাহী না, এই ভিন্নমতের সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশের বদলে তাঁরা চান কণ্ঠ রোধ করতে। আর এই লক্ষ্যে যুক্ত হয়েছে জনগণের অর্থে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলো, সেই অর্থে বাংলা একাডেমির ভূমিকা ভিন্ন নয়।

আসন্ন বইমেলায় আদর্শ প্রকাশনীকে দেওয়া স্টলের অনুমোদন বাংলা একাডেমি স্থগিত করেছে বলে জানা গেছে। বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো রকম ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। কিন্তু আদর্শ প্রকাশনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে এ সিদ্ধান্তের ভিত্তি হচ্ছে একাডেমির কাছে অন্যদের অভিযোগ। অভিযোগ হচ্ছে, আদর্শের প্রকাশিত তিনটি বইয়ে ‘ভিন্নমত’ আছে। তিনটি বই হচ্ছে—জিয়া হাসানের ‘উন্নয়ন বিভ্রম’, ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবের ‘অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবনীয় কথামালা’ এবং ফাহাম আবদুস সালামের ‘বাঙালির মিডিয়োক্রিটির সন্ধানে’। বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে নেওয়া এ সিদ্ধান্তের একটি ব্যাখ্যা যে কেউ দাবি করতে পারেন। বাংলা একাডেমি জনগণের অর্থে পরিচালিত প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠা হয়েছে ‘ভিন্নমত’-এর কারণেই। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রতিষ্ঠান তৈরির দাবি উঠেছিল, প্রতিষ্ঠা হয়েছিল যুক্তফ্রন্ট সরকারের সময়। ভাষা আন্দোলনের ভিত্তি হচ্ছে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে ভিন্নমত—বাংলা ভাষার মর্যাদার প্রশ্নে ভিন্নমত। বাংলা একাডেমি এখন সেই ভিন্নমত দমনের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। ভিন্নমতের কারণে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে, তা হবে সেন্সরশিপের সবচেয়ে প্রত্যক্ষ উদাহরণ।

এ ধরনের ঘটনা বাংলা একাডেমিতে এই প্রথম ঘটল, তা নয়। আগেও এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ২০১৬ সালে বইমেলার আগে সংবাদ সম্মেলনে একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেছিলেন, তাঁরা চান না বইমেলায় উসকানিমূলক বই বিক্রি হোক। এ রকম অভিযোগে ২০১৫ সালে একটি প্রকাশনীর স্টল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এগুলোই প্রমাণ করে, বাংলাদেশে মতপ্রকাশের ওপর কত ধরনের আইনি ও আইনবহির্ভূত চাপ উপস্থিত। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, এই যে বলা হচ্ছে একাডেমির কাছে এ বিষয়ে অভিযোগ করেছেন অন্য প্রকাশকেরা। এ থেকে কেবল বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের অবস্থাই বোঝা যায়, তা নয়। বোঝা যায় যে সেন্সরশিপের হাতিয়ার কেবল রাষ্ট্র নয়, এর বাইরে সমাজেও এগুলো ব্যাপকভাবে উপস্থিত। সমাজে ভিন্নমত না থাকাটাই তাদের আরাধ্য, সমাজে ভিন্নমত না থাকলে রাজনীতিতেও থাকবে না।

রাজনীতি মানেই হচ্ছে ভিন্নমত। যাঁরা ভিন্নমতকে দমিয়ে দিতে চান, তাঁরা প্রকাশক হতে পারেন, পত্রিকার সম্পাদক হতে পারেন কিংবা সাংস্কৃতিক কর্মী। তাঁদের আমরা যে পরিচয়েই চিনি না কেন, তাঁরাই হচ্ছেন কর্তৃত্ববাদের সামাজিক ভিত্তি। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে যাঁরা লড়াই করতে চান, তাঁদের কাজ হচ্ছে, এ ধরনের প্রবণতাগুলো শনাক্ত করা এবং তা মোকাবিলা করা। এই কাজ জরুরি। প্রকাশকদের বিভিন্ন ধরনের সংগঠনের কথা শোনা যায়, তাঁরা এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন বলে শোনা যায়নি। আজকে যাঁরা কথা বলছেন না, তাঁরা ভবিষ্যতে এ অবস্থার শিকার হবেন না, তার নিশ্চয়তা কোথায়?

প্রচলিত চিন্তার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ ও প্রকাশ করা এবং প্রচলিত শক্তির বিপরীতে কথা বলাই হচ্ছে চিন্তাশীল মানুষের কাজ। স্বাধীন চিন্তাশীল লেখক ও বুদ্ধিজীবীর দায়িত্বই হচ্ছে ক্রমাগতভাবে প্রচলিত ধ্যানধারণাকে চ্যালেঞ্জ করা। কেন এই চ্যালেঞ্জ করা দরকার? এর উত্তর পাওয়া যায় কাজী মোতাহার হোসেনের কথায়। বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকে শিখা গোষ্ঠীর দ্বিতীয় বার্ষিক প্রতিবেদনে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন কী, তা ব্যাখ্যা করে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমরা চক্ষু বুঝিয়া পরের কথা শুনিতে চাই না বা শুনিয়াই মানিয়া লইতে চাই না; আমরা চাই চোখ মেলিয়া দেখিতে, সত্যকে জীবনে প্রকৃতভাবে অনুভব করিতে। আমরা কল্পনা ও ভক্তির মোহ আবরণে সত্যকে ঢাকিয়া রাখিতে চাই না। আমরা চাই জ্ঞান শিক্ষা দ্বারা অসার সংস্কারকে ভস্মীভূত করিতে এবং সনাতন সত্যকে কুহেলিকা মুক্ত করিয়া ভাস্বর ও দীপ্তিমান করিতে।…এককথায় আমরা বুদ্ধিকে মুক্ত রাখিয়া প্রশান্ত জ্ঞান দৃষ্টি দ্বারা বস্তু জগৎ ও ভাবজগতের ব্যাপারাদি প্রত্যক্ষ করিতে ও করাইতে চাই।’ একেই বলে ভিন্নমত হওয়া, একেই বলে উসকানি দেওয়া।

যে তিনটি বইয়ের কথা বলা হয়েছে, এর মধ্যে দুটি বই অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে আমি পড়েছি। জিয়া হাসানের ‘উন্নয়ন বিভ্রম’এবং ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবের ‘অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবনীয় কথামালা’ পড়ে আমারও মনে হয়েছে, তাঁরা ‘ভিন্নমত’ প্রকাশ করেছেন। এই দুই বইয়ে লেখকেরা তাঁদের অবস্থান থেকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্যের ব্যাপারে সরকারি ভাষ্যের সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন। তাঁদের বক্তব্যের স্বপক্ষে তাঁরা তথ্য-উপাত্ত-পরিসংখ্যান হাজির করেছেন। তাঁরা দেখাতে চেয়েছেন যে এক দশকের বেশি সময় ধরে যে অর্থনৈতিক সাফল্যের কথা বলা হয়েছে, তাতে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি প্রতিফলিত হয় না; বিভিন্নভাবেই উন্নয়নের এ ভাষ্যকে প্রশ্ন করা যায় এবং তা করা দরকারও।

এ ধরনের ভিন্নমত যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটা বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার ইতিহাসের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। এই ইতিহাসের সঙ্গে যাঁরা পরিচিত, তাঁরা জানেন যে পাকিস্তানের শাসকেরা যখন এ রকম দাবি করছিল যে পাকিস্তানের সর্বত্র উন্নয়ন সমভাবে বণ্টিত হচ্ছে, সেই সময় কয়েকজন অর্থনীতিবিদ এই নিয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করেছিলেন। পাকিস্তানের প্রথম খসড়া পঞ্চবার্ষিক (১৯৫৬-১৯৬০) পরিকল্পনার উন্নয়ন কৌশল প্রণয়নের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতিবিদদের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৫৬ সালের আগস্ট মাসে ঢাকায়। সেই সম্মেলনে উপস্থাপন করা হয়েছিল দুই অর্থনীতির তত্ত্ব। এই তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছিলেন ১০ জন অর্থনীতিবিদ—এম এন হুদা, মাজহারুল হক, এ রাজ্জাক, নুরুল ইসলাম, এ সাদেক, এ ফারুক, এ এন এম মাহমুদ, মো. সাইফুল্লাহ মুহাম্মদ হোসেন ও শফিকুর রহমান। এই মতামতের ভিত্তিতেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আত্মনিয়ন্ত্রাধিকার আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল (এ বিষয়ে বিস্তারিত দেখুন, নূরুল ইসলাম, ‘ছয় দফা ও দুই অর্থনীতি’, প্রতিচিন্তা, অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০১৫)। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে।

আমরা এমন এক সময়ে বাস করি, যাকে ‘সহমতের বন্যা প্লাবিত’ বলেই বর্ণনা করা যায়। এই সময়ে জিয়া হাসান ও ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব যে ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন, সেজন্য তাঁদের প্রাপ্য সাধুবাদ—সেন্সরশিপ নয়। তাঁদের মতো যাঁরাই ভিন্নমত প্রকাশ করেন, যুক্তি দিয়ে, তথ্য দিয়ে আমাদের বোঝাতে চান, তাঁদের প্রত্যেকেরই এই সাধুবাদ প্রাপ্য। যাঁরা ‘ভক্তির মোহ আবরণে সত্যকে ঢেকে রাখতে’ চান, তাঁরা যুক্তি দিয়ে এই ভিন্নমতকে মোকাবিলা করতে উৎসাহী না, এই ভিন্নমতের সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশের বদলে তাঁরা চান কণ্ঠ রোধ করতে। আর এই লক্ষ্যে যুক্ত হয়েছে জনগণের অর্থে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলো, সেই অর্থে বাংলা একাডেমির ভূমিকা ভিন্ন নয়। কিন্তু এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আমাদের নৈতিক কর্তব্য।

*প্রবন্ধটি ১৮ জানুয়ারি ২০২৩ প্রথম আলো-তে প্রকাশিত হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Leave a comment
scroll to top