Close

কী ঘটছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে

এমনিতেই সীমাহীন স্বজনপ্রীতি, অব্যবস্থাপনা, ব্যাপক লুটপাট এবং লুটের টাকা বিদেশে পাচারসহ নানা অনিয়মের কারণে আমরা ভয়াবহ আর্থিক সংকটের মধ্যে আছি। নগ্ন দলীয়করণ, অদক্ষতা, জবাবদিহিতার অভাব ও সর্বগ্রাসী দুর্নীতির কারণে আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোও এখন ভঙ্গুর অবস্থায়। নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস হওয়ার এবং নাগরিক অধিকার হরণের ফলে গণতন্ত্রহীনতা আমাদের ওপর এখন জেঁকে বসেছে। সুশাসনের অভাব আজ সর্বত্র।

[সম্পাদকীয় মন্তব্য : অর্থনীতিবিদ, উন্নয়নকর্মী, গবেষক, রাজনীতি বিশ্লেষক, স্থানীয় সরকার ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. বদিউল আলম মজুমদারের সাক্ষাৎকারটি গত ৮ নভেম্বর ২০২২ সালে সাহিত্য বাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।]

কী ঘটছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ নিয়ে আমরা মুখোমুখি হয়েছিলাম এ সময়ের আলোচিত কয়েকজন সমাজ চিন্তক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকের সাথে। তাদের একজন ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি একাধারে অর্থনীতিবিদ, উন্নয়নকর্মী, গবেষক, রাজনীতি বিশ্লেষক, স্থানীয় সরকার ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ। ড. বদিউল আলম মজুমদার বর্তমানে আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাব্রতী সংস্থা ‘দি হাঙ্গার প্রজেক্ট’র কান্ট্রি ডিরেক্টর ও গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং নাগরিক সংগঠন ‘সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক’ এর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

কিছুদিন আগে চলমান স্থানীয় সরকার নির্বাচন প্রসঙ্গ ও সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে তিনি বলেন, গত এক দশক ধরে নির্বাচনের যে সংস্কৃতি বিরাজ করছে, তা থেকে বিশেষ কোনো নির্বাচনকে আলাদা করে মূল্যায়ন করার সুযোগ নেই। ২০১৩ সালের পর থেকে বাংলাদেশে আর কোনো নির্বাচন সঠিক নিয়মে হয়নি। ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ গাজীপুর-সহ পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু করেছিল বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে। ভোট সুষ্ঠু করে তারা দেখাতে চেয়েছিল যে দলীয় সরকারের অধীনেও সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে। কিন্তু চারটিতেই ভরাডুবি হয় দলটির। এরপর আর ঝুঁকি নিতে চায়নি আওয়ামী লীগ। যার ফলাফল আমরা প্রতিটি নির্বাচনেই এখন দেখতে পাচ্ছি। নির্বাচন মানেই এখন আতঙ্ক, আর সম্ভাব্য সহিংসতা। অসংখ্য জায়গায় প্রার্থিরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হচ্ছেন। টাকা আছে যার বা ক্ষমতার কাছে যিনি অবস্থান করছেন, তিনিই নির্বাচনে জিতে আসছেন এবং সেটা যেভাবেই হোক না কেন। এই পরিস্থিতি হলো বড় রোগের লক্ষণ। অনিয়মের নির্বাচন আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে একেবারেই খাদের কিনারে নিয়ে গেছে। অর্থ ও পেশিশক্তির বৃত্তে ঘেরা এমন নির্বাচনে কোনোভাবেই জনগণের সম্মতির প্রতিফলন ঘটছে না। তাই নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ করতে হলে প্রথমে রাজনীতিকে কুলুষমুক্ত করতে হবে। অর্থে ও পেশিশক্তির রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। সমাজে যে অসঙ্গতি, দুর্নীতি বিরাজ করছে তা রোধ করতে হবে। অপশাসন থামাতে হবে। যদিও এসবের জন্য আমাদের অপরাজনীতিই দায়ী। তার মানে একটি পরিষ্কার করতে পারলে অন্যটিও পরিষ্কার হবে।

ড. মজুমদার আরও বলেন, অনেকে বলছেন সাম্প্রতিক সময়ে অনুষ্ঠিত স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে ভোটারদের অংশগ্রহণ বেশ লক্ষণীয় ছিল, নির্বাচনগুলোও মোটামুটি সুষ্ঠু হচ্ছে। কিন্তু তাদের পর্যবেক্ষণ পুরোপুরি সঠিক নয়। কারণ ইভিএমে যে কোনো ফলাফল দেখানো যায় বলে অনেকে মনে করে। তাছাড়া নির্বাচন আগের চেয়ে কম প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হচ্ছে, নির্বাচন নিয়েও ভোটারদের আগ্রহ কমে গেছে। আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে উল্লেখ্যযোগ্য পরিমাণ প্রার্থী থাকতো। এখন দলীয় প্রতীকে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় এবং নির্বাচনের মাঠে বিরোধী দলগুলোর অনুপস্থিতির কারণে প্রার্থী সংখ্যা ও যোগ্য প্রার্থীর সংখ্যা কমে গেছে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অনেকে নির্বাচিত হচ্ছেন। ক্ষমতাসীন দলের বাইরে অন্য প্রার্থীরা প্রচার করতে পারেন না। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের কমিশনের পক্ষ এসব অনিয়ম ও সহিংসতা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। কমিশনের নিজের প্রশ্নবিদ্ধ আচরণের কারণে তাদের ওপর জনগণের আস্থা আজ প্রায় শূন্যের কোঠায়।

ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বিএনপি এখন শাঁকের করাত। একটি রাজনৈতিক দল দীর্ঘদিন নির্বাচনে অংশ না নিলে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। দল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিএনপির এখন সেই অবস্থা। কী করবে তারা বুঝে উঠতে পারছে না। অন্যদিকে নির্বাচনে জয়ের মাধ্যমে ফায়দা হাসিলের জন্য আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা অনেক জায়গায় বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষে যুক্ত হয়ে পড়ছে।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগ প্রত্যক্ষভাবে বিএনপিকে দুর্বল করা এবং পরোক্ষভাবে বিএনপির কোমর ভেঙে ফেলার চেষ্টা করলেও খুব একটা সফল হয়নি বলে মনে হয়। বিএনপি সাম্প্রতিক সময়ে বিভাগীয় সমাবেশ আয়োজন করার মধ্য দিয়ে দলীয় ঐক্য সুসংহত করা, স্থানীয় পর্যায়ে নেতা-কর্মীদের উজ্জীবিত করা এবং নিজেদের পক্ষে জনসমর্থন দেখাতে সফল হয়েছে। এতে আওয়ামী লীগের মধ্যে বিএনপিকে নিয়ে চিন্তা বেড়েছে এবং বিএনপির সভা-সমাবেশের আগে অঘোষিত পরিবহন ধর্মঘট ডাকা ও বিভিন্নভাবে দলটির ওপর চাপ তৈরি করছে। আমরা মনে করি, শান্তিপূর্ণভাবে সভা-সমাবেশ করার অধিকার সব রাজনৈতিক দলেরই রয়েছে। তবে এ যেন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। আওয়ামী লীগকে কোনঠাসা করে রাখার বিএনপির অতীতের প্রচেষ্টার ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবে বর্তমানে বিএনপিকে কোনঠাসা করে রাখতে চাইছে আওয়ামী লীগ।

ইভিএম প্রসঙ্গে ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বিতর্ক, সন্দেহ আর আস্থাহীনতার ঘেরাটোপ থেকে কোনোভাবেই যেন বের হয়ে আসতে পারছে না আমাদের নির্বাচন কমিশন। সর্বাধিক বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে কমিশনের আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়ে।

‘অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ইভিএমে বিশ্বাস করছে না’’—সিইসির এ বক্তব্যের পর হঠাৎ করেই কমিশন ১৫০টি আসনে ইভিএম ব্যবহারের ঘোষণা দেয়। সিইসির দাবি অনুযায়ী, এ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে কমিশন রাজনৈতিক দলের মতামতের ওপর গুরুত্ব দেয়নি। কারণ, নির্বাচন সুষ্ঠু করার দায়িত্ব কমিশনের। কিন্তু পরে নির্বাচন নিয়ে নিজেদের কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করতে গিয়ে অন্য কমিশনাররা দাবি করেন যে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল ইভিএমের পক্ষে, যদিও বাস্তবে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল এর বিপক্ষে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে এ দাবি করতে গিয়ে তাঁরা প্রতারণামূলকভাবে রাজনৈতিক দলের বক্তব্যকে পাল্টে দিয়েছেন। ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে কমিশন একটি বিভ্রান্তিকর ধূম্রজালও সৃষ্টি করেছে। কমিশন দাবি করছে যে ইভিএম দিয়ে ভোট জালিয়াতি করা যায়, কেউ তা প্রমাণ করতে পারেনি। ইভিএম দিয়ে অন্য কেউ জালিয়াতি করতে পারে, সে অভিযোগ এখনো কেউ করেনি, যদিও কমিশনের যোগসাজশে তা করা সম্ভব। ইভিএম নিয়ে জালিয়াতি করতে পারে নির্বাচন কমিশন, তাদের কর্মকর্তা, তাদের কারিগরি টিম ও তাদের নিয়োজিত মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা।

সাম্প্রতিক সময়ে প্রধানমন্ত্রীর দুর্ভিক্ষ টেনে আনা নিয়ে অর্থনৈতিক সংকটের মূলে রাজনৈতিক অঙ্গীকারের বরখেলাপ উল্লেখ করে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী সবাইকে সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ ও খাদ্যঘাটতি নিয়ে সতর্ক করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টাও প্রয়োজনে দিনের বেলায় বিদ্যুৎ বন্ধ রাখার আশঙ্কা সম্পর্কে আমাদের সাবধান করেছেন। এমনিতেই সীমাহীন স্বজনপ্রীতি, অব্যবস্থাপনা, ব্যাপক লুটপাট এবং লুটের টাকা বিদেশে পাচারসহ নানা অনিয়মের কারণে আমরা ভয়াবহ আর্থিক সংকটের মধ্যে আছি। নগ্ন দলীয়করণ, অদক্ষতা, জবাবদিহিতার অভাব ও সর্বগ্রাসী দুর্নীতির কারণে আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোও এখন ভঙ্গুর অবস্থায়। নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস হওয়ার এবং নাগরিক অধিকার হরণের ফলে গণতন্ত্রহীনতা আমাদের ওপর এখন জেঁকে বসেছে। সুশাসনের অভাব আজ সর্বত্র। এরপর মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে যুক্ত হয়েছে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, যা সৃষ্টি করছে সাধারণ মানুষের সীমাহীন ভোগান্তি। আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে যে দিনবদলের সনদ ঘোষণার মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিল তার অনেকটাই বরখেলাপ করেছে দলটি। এ যেন বিশ্বাস ভঙ্গের রাজনীতি।

তিনি বলেন, যদিও গণতন্ত্রহীনতা, সুশাসনের অভাব এবং অর্থনৈতিক সংকট অনেক দিন থেকেই আমাদের দেশে পুঞ্জীভূত হচ্ছিল, জনজীবনে এগুলোর প্রভাব আরও প্রকট হয়েছে সাম্প্রতিক কালে, বিশেষত কোভিড মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে। দুর্ভাগ্যবশত, ক্রমবর্ধমান এসব সংকটের মূলে রয়েছে ক্ষমতাসীনদের অঙ্গীকারের নগ্ন বরখেলাপ ও সীমাহীন অব্যবস্থাপনা।

সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Leave a comment
scroll to top