Close

উপাত্ত সুরক্ষা আইন পাস হলে বড় ধাক্কা খাবে অর্থনীতি : সাইমুম রেজা

আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার—এ তিন মূলনীতি আছে। সে অর্থে বাংলাদেশ একটা কল্যাণকামী রাষ্ট্র, যা নাগরিকের অধিকার সুরক্ষার জন্য কাজ করবে। ডিজিটাল মাধ্যমে অপরাধ শনাক্তকরণ ও দমন করার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। আইনের শিরোনামটা অন্যভাবে করা যেত। ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ না বলে ‘ডিজিটাল স্বাধীনতা আইন’ বলা যেত। কারণ, আইনের শিরোনামে কোন শব্দ চয়ন করা হচ্ছে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা কি শুধু নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা করব, নাকি নিরাপত্তা নিয়ে ভাবার সঙ্গে স্বাধীনতা নিয়েও ভাবব?

সম্পাদকীয় নোট : সাইমুম রেজা স্কুল অব ল, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক। নেদারল্যান্ডসের লেইডেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন ও ডিজিটাল প্রযুক্তি বিষয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। গত ১৮ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, প্রস্তাবিত উপাত্ত সুরক্ষা আইনসহ ডিজিটাল দুনিয়ায় নাগরিকের স্বাধীনতা ও অধিকার নিয়ে কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনোজ দে ও মনজুরুল ইসলাম। সাইমুম রেজার অনুমতি সাপেক্ষে সাক্ষাৎকারটি ফোরামে প্রকাশিত হলো।

বর্তমানে আমরা অনলাইন ও অফলাইন দুই জগতেই বিচরণ করি। আমাদের আইন ও অধিকারগুলো দুই জায়গায়ই কি একই থাকবে?

সাইমুম রেজা: আমাদের সংবিধানের তৃতীয় ভাগে মৌলিক অধিকারের সংজ্ঞা দেওয়া আছে, যা কিছু যুক্তিসংগত বিধিনিষেধ আরোপ সাপেক্ষে আদালত কর্তৃক বলবৎযোগ্য। বাংলাদেশ ‘সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি ১৯৬৬’-তে স্বাক্ষরকারী দেশ। সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদের আলোকে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আইনের ও জাতিসংঘের সনদে বর্ণিত নীতিগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করবে। সে হিসেবে ‘মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র ১৯৪৮-সহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক আইন ও সনদকেও বাংলাদেশে সম্মান করতে হবে। এ সবকিছু বিবেচনায় নাগরিকের বেশ কিছু অধিকার স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে সংবিধান যখন প্রণীত হয় এবং এসব আন্তর্জাতিক সনদ যখন স্বাক্ষর করা হয়, সে সময় ইন্টারনেট ছিল না। এখন অনলাইন ও অফলাইন দুই জগৎই আমাদের বাস্তবতা। প্রশ্ন হলো, যেসব অধিকার আমরা অফলাইনে ভোগ করি, সেসব অধিকার কি অনলাইনেও প্রযোজ্য হবে, নাকি অনলাইন জগতের জন্য সম্পূর্ণ নতুন ধরনের অধিকার সৃষ্টি করতে হবে? জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিটি ২০১৬ সালে একটি রেজল্যুশন পাস করেছিল, যাতে বলা আছে, যেসব অধিকার অফলাইনে প্রযোজ্য, সেসব অধিকার অনলাইনেও প্রযোজ্য। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিটির ২০১৬ সালের রেজল্যুশনের সারমর্মটি আমাদের আইসিটি-সংক্রান্ত আইন ও মূলনীতিগুলোতেও প্রতিফলিত হওয়া উচিত।

অনলাইন জগতে আইনের শাসন কি অফলাইন জগতের আইনের শাসনের ধরনের চেয়ে আলাদা?

সাইমুম রেজা: নাগরিকের সঙ্গে রাষ্ট্রের একটা অলিখিত চুক্তি থাকে। রাষ্ট্র ও নাগরিক—সবাই আইনের শাসনের মধ্যে থাকে। রাষ্ট্র, নাগরিক কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। বাস্তব জগতে আইনের প্রয়োগের মূল দায়িত্ব পালন করে রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট ভূখণ্ড থাকলেও সাইবার স্পেস অভিন্ন সীমানাহীন ভূখণ্ড। সাইবার স্পেস হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার যেমন নিয়ন্ত্রণ করে, নাগরিকেরাও তাঁদের আচরণের মাধ্যমে একধরনের নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা গড়ে তোলেন এবং রাষ্ট্রের আইনও সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করে। তবে সাইবার স্পেস পরিচালনার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র নেতৃত্বদায়ী শক্তি নয়। যাদের হাতে সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যারের নিয়ন্ত্রণ আছে, সেই প্রযুক্তি-প্ল্যাটফর্মগুলোর হাতেই মূল নিয়ন্ত্রণটা থাকে। ফেসবুক, গুগলের মতো টেক জায়ান্ট বা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো রাষ্ট্রে নিবন্ধিত না হলে সেই দেশের নিয়মকানুন মানতে তারা বাধ্য নয়। এ কারণে সাইবার স্পেসে রেগুলেশনের ধারণা আলাদা, আইনের বিধিনিষেধের ধারণা আলাদা, সুশাসনের ধারণা আলাদা। কিন্তু সাইবার স্পেসের এসব চরিত্রগত ধরন বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তিসংক্রান্ত আইনগুলোয় খুব বেশি প্রতিফলিত হয়নি। এ কারণেই এসব আইনের অনেক ধারা বা ধারণা সাইবার স্পেসের উপযোগী নয়। এসব আইন দিয়ে সাইবার স্পেসে সুশাসন কতটুকু নিশ্চিত করা যাবে, সে ব্যাপারে সন্দেহ থেকেই যায়।

ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধ শনাক্তকরণ, প্রতিরোধ ও দমনের যুক্তি দিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। বাস্তবে আইনটির উদ্দেশ্য কি পূরণ হচ্ছে?

সাইমুম রেজা: আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার—এ তিন মূলনীতি আছে। সে অর্থে বাংলাদেশ একটা কল্যাণকামী রাষ্ট্র, যা নাগরিকের অধিকার সুরক্ষার জন্য কাজ করবে। ডিজিটাল মাধ্যমে অপরাধ শনাক্তকরণ ও দমন করার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। আইনের শিরোনামটা অন্যভাবে করা যেত। ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ না বলে ‘ডিজিটাল স্বাধীনতা আইন’ বলা যেত। কারণ, আইনের শিরোনামে কোন শব্দ চয়ন করা হচ্ছে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা কি শুধু নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা করব, নাকি নিরাপত্তা নিয়ে ভাবার সঙ্গে স্বাধীনতা নিয়েও ভাবব?

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ধারাগুলো এবং বিষয়বস্তু দেখলে একটি সংশয়ের সৃষ্টি হয়। সাইবার অপরাধ দমন, শনাক্তকরণ ও প্রতিরোধ, জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা এবং আধেয় পরিমার্জন (কনটেন্ট মডারেশন)—তিনটি বিষয়কে এখানে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ব্যাখ্যা বা সংজ্ঞা দেওয়া হয়নি। যেকোনো আইন দ্বারা উদ্দেশ্য সাধন করতে হলে সেটি সুলিখিত, বিস্তারিত ও ধারাবাহিক হতে হয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের উদ্দেশ্যেই ধোঁয়াশা রয়েছে। এ আইনের সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যার ঘাটতি রয়েছে। এসব কারণে আইনটির মাধ্যমে সাইবার জগতের প্রকৃত ঝুঁকিগুলো মোকাবিলা করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।

এ ছাড়া এ আইনের কিছু কিছু ধারায় মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে অপরাধীকরণ (ক্রিমিনালাইজ) করা হয়েছে। মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র ১৯৪৮ ও ‘সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি ১৯৬৬’-এর ১৯ অনুচ্ছেদ এবং আমাদের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদের আলোকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। তবে কিছু যুক্তিসংগত বিধিনিষেধ সাপেক্ষে কখনো কখনো মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত করা যায়। এ ক্ষেত্রে সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি ১৯৬৬-এর ১৯ অনুচ্ছেদের আলোকে সারা বিশ্বে তিনটি মূলনীতি অনুসরণ করা হয়। কিন্তু আমাদের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এর প্রতিফলন নেই।

উপাত্ত সুরক্ষা আইনের খসড়ায় ব্যক্তিগত তথ্যের ওপর সরকারি নজরদারির ঝুঁকি রয়েছে বলে অংশীজনেরা বলছেন। আপনি কী মনে করেন?

সাইমুম রেজা: খসড়ার ৪২ ও ৪৩ ধারায়, উপাত্ত লোকালাইজেশনের কথা বলা হয়েছে। এর মানে হচ্ছে বাংলাদেশের কোনো ব্যক্তি যদি কোনো উপাত্ত উৎপাদন করেন কিংবা গ্রহণ করেন কিংবা বাংলাদেশে কোনো কোম্পানি যদি ব্যবসা পরিচালনা করে, তাহলে তাদের উপাত্তগুলো বাংলাদেশে অবস্থিত কোনো ডেটা সেন্টারে রাখতে হবে। এটা অনেক বেশি সমস্যাজনক একটা বিধি। প্রশ্ন হলো, ডেটা সেন্টারগুলোর নিয়ন্ত্রণ কার কাছে থাকবে? সেগুলোর নিয়ন্ত্রণ কি সরকারের হাতে থাকবে, নাকি স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের কাছে থাকবে? এর সুস্পষ্ট কোনো রূপরেখা এই আইনের খসড়ায় নেই। উপাত্ত সুরক্ষা আইনের খসড়ায় বলা আছে, জাতীয় উপাত্ত সুরক্ষা কর্তৃপক্ষের মহাপরিচালক সময় সময় বিধি প্রণয়ন করতে পারবেন। এখন প্রশ্ন হলো, সেই বিধি প্রণয়নের মাধ্যমে কি ডেটা সেন্টারের সার্ভারে থাকা কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের উপাত্ত সরকারের কোনো সংস্থা বা কর্তৃপক্ষ চাইলে নিতে পারবে?

আরেকটি বিষয়, ২০১৪ সালে প্রণীত আমাদের জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা কৌশল ২০১৪-এর সঙ্গেও উপাত্ত সুরক্ষা আইনের খসড়া সাংঘর্ষিক। একটা সহজ দৃষ্টান্ত দিয়ে বোঝানো যাক। আমরা জি-মেইল ব্যবহার করে যখন মেইল করি, তখন সেটার একটা কপি কোনো না কোনো ডেটা সেন্টারে সংরক্ষণ করা হয়। সেই ডেটা সেন্টারটি সান ফ্রান্সিসকোতে নাকি সিডনিতে, সেটা টেক প্ল্যাটফর্মগুলো কখনোই জানায় না। এখানে নিরাপত্তার প্রশ্ন রয়েছে। ডেটা সেন্টার শনাক্ত হয়ে গেলে সাইবার অপরাধীরা সেটাকে লক্ষ করে হামলা চালাতে পারে। বাংলাদেশে উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন আধুনিক মানের ডেটা সেন্টারই হাতে গোনা, সেগুলো চিহ্নিতও। ফলে সেখানে সহজেই সাইবার হামলা হওয়ারও আশঙ্কা থেকে যায়।

প্রস্তাবিত খসড়ার ৩৩ ধারায় বলা আছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এ আইনের আওতার বাইরে থাকবে এবং ৩৪ ধারায় তাদের অধিকতর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তার মানে এসব সংস্থা নাগরিকের কোনো তথ্য নিতে চাইলে বা নজরদারি করতে চাইলে সেটা কি অবাধ করতে পারবে? যদি তা-ই হয়, তাহলে ব্যক্তিগত উপাত্তের সুরক্ষা কীভাবে নিশ্চিত হলো? যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তা আমাদের সাংবিধানিক ও মৌলিক অধিকার। উপাত্ত সুরক্ষা আইনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দেওয়া এ ধরনের অব্যাহতি সরাসরি সংবিধানের ৪৩ ধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

উপাত্ত সুরক্ষা আইনের খসড়া নিয়ে দেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায় উদ্বেগ জানিয়েছে। খসড়া যেমনটা আছে, সেভাবে আইনটি পাস হলে ব্যবসা-বাণিজ্যে কতটা প্রভাব পড়বে?

সাইমুম রেজা: আমাদের দেশ বিচ্ছিন্ন কোনো অর্থনীতির দেশ নয়, বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে আমাদের অর্থনীতি নিবিড়ভাবে যুক্ত। প্রস্তাবিত উপাত্ত সুরক্ষা আইন নিয়ে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বড় একটা উদ্বেগ ও শঙ্কা তৈরি হয়েছে। আমাদের দেশের অনেক তরুণ এখন ফ্রিল্যান্সিং করেন। ইউরোপ বা আমেরিকার কোনো প্রতিষ্ঠান যখন আমাদের দেশের কোনো ফ্রিল্যান্সারকে কাজ দেবে, তখন তারা বিবেচনা করবে, তাদের উপাত্ত সুরক্ষাসংক্রান্ত আইন ও বিধির সঙ্গে আমাদের দেশের উপাত্ত সুরক্ষা আইন সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না। সাংঘর্ষিক হলে তারা চাইলেও আমাদের কাজ দিতে পারবে না। বাংলাদেশের উপাত্তসংক্রান্ত আইন তাদের জন্য নিরাপদ স্থান (সেফ হারবার) না হলে তারা বাণিজ্যিক লেনদেনে যেতে পারবে না। তাই ডেটা লোকালাইজেশনের মতো বিষয় তথ্য-উপাত্ত আইনে থাকলে সেবা, স্বাস্থ্য, ব্যাংকিং, হসপিটালিটি, ইনফরমেশন সার্ভিস—এসব খাত অর্থনৈতিকভাবে ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। কার্যাদেশ না পেলে নিশ্চিতভাবেই আমরা একটা অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ব। এ ছাড়া আমাদের ডিজিটালাইজেশন পরিকল্পনা, ই-কমার্স বিকাশের গাইডলাইন প্রস্তাবিত উপাত্ত সুরক্ষা আইনে উল্লেখিত ডেটা লোকালাইজেশনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থা বাংলাদেশে কাজ করলে তাদের উপাত্ত বাংলাদেশের ডেটা সেন্টারে রাখতে হবে কি না, তারা অব্যাহতি পাবে কি না, সেটা নিয়ে উপাত্ত সুরক্ষা আইনে ধোঁয়াশা আছে। প্রস্তাবে বলা হচ্ছে, অন্য দেশের জুরিসডিকশন বাংলাদেশে প্রযোজ্য হবে না। এ ধরনের ধারার কারণে অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সংঘাতের দিকে চলে যেতে পারে। ফলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতে পারে। এটা আমাদের পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

আশা করা হয়েছিল, ডিজিটাল মাধ্যম বিশ্বে গণতন্ত্র বিকাশের সুযোগ এনে দিয়েছে। বাস্তবে অনেক সময়ই এর উল্টো চিত্র আমরা দেখছি। এর কারণ কী বলে মনে করেন?

সাইমুম রেজা: প্রযুক্তি এবং সাইবার স্পেস আমাদের আচরণগত পরিবর্তন ঘটিয়েছে। ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ধারণার ক্ষেত্রেও পরিবর্তন এসেছে। অনলাইনে যেহেতু আমাদের আচরণগত ও মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন হয়, সেহেতু এখানে অপরাধ সংঘটনের মাত্রা, ব্যাপ্তি এবং ধরনেরও পরিবর্তন হতে পারে। তাই অনলাইনের জন্য প্রণীত আইনগুলো এসব বৈশিষ্ট্য মাথায় রেখে প্রণয়ন করতে হবে। আবার অনলাইনে আমরা নিজেদের নেটিজেন বলি। নেটিজেনরা কোনো রাষ্ট্রীয় সীমানা দিয়ে সীমাবদ্ধ নয়। এ বিবেচনায় অনলাইন কমিউনিটি একটি বৈশ্বিক জনগণ হিসেবে প্রভাব রাখতে পারে এবং গণতান্ত্রিক পরিসরকে একটু নতুন আঙ্গিক দিতে পারে। আমরা ইতিমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে অনলাইনের মাধ্যমে পরিচালিত বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে উঠতে দেখেছি। আবার সেই অনলাইনকে ব্যবহার করে কর্তৃত্বপরায়ণ ও অগণতান্ত্রিক শাসকগোষ্ঠীকে ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের চিহ্নিত করে আন্দোলন দমন করতেও দেখেছি। আমরা যদি সাইবার স্পেসের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যগুলো বুঝতে না পারি, এটি ব্যাপকভাবে দমন-পীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।

সামনে নির্বাচন, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। এ অবস্থায় বাস্তবে মাঠ দখলের পাশাপাশি ডিজিটাল মাধ্যমেও রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখতে মরিয়া হয়ে ওঠে, তাহলে তা নাগরিকদের জন্য কি আশঙ্কার কারণ?

সাইমুম রেজা: আমরা দেখেছি অনলাইন প্রচারণার মাধ্যমে কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এবং যুক্তরাজ্যের ব্রেক্সিট গণভোটকে প্রভাবিত করা হয়েছিল। কিছুদিন আগে ফিলিপাইনে স্বৈরশাসক ফার্দিনান্দ মার্কোসের ছেলে জুনিয়র মার্কোস (বংবং মার্কোস নামে পরিচিত) প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয় পেয়েছেন। অভিযোগ আছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রোপাগান্ডার ফলে অতীত ইতিহাসকে ভুলিয়ে দিয়ে তিনি নির্বাচনে জয় লাভ করেছেন। নির্বাচনের সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা ধরনের প্রোপাগান্ডা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং পরিবেশের জন্য হুমকি সৃষ্টি করে, এমনটাই আমরা দেখছি। এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান, সরকার ও নাগরিক—সবারই দায় আছে এবং সবাইকেই অনলাইন প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে এ ধরনের গণতন্ত্রবিধ্বংসী কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে হবে। অনলাইনের এসব কর্মকাণ্ডের রেশ অফলাইনেও নানা মাত্রায় প্রতিফলিত হয়। সেটি অনেক সময় সহিংস ও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।

‘ডিজিটাল অধিকার’ ও ‘ডিজিটাল সাংবিধানিকতাবাদ’ ধারণাগুলো নতুন। সামনের দিনগুলোয় এসব ধারণা কি আমাদের সাংবিধানিক সংস্কারের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক?

সাইমুম রেজা: আমরা এখন বড় একটা সময় অনলাইনে বিচরণ করি। এ বাস্তবতায় আমাদের সংবিধানে ‘ডিজিটাল অধিকার’ বিষয়টিও যোগ করা প্রয়োজন। ‘ডিজিটাল সাংবিধানিকতাবাদ’ ধারণাটি সম্পূর্ণ নতুন ধারণা। এর সারমর্ম হলো অনলাইনের জন্য যখন নানা ধরনের আইন, নীতিমালা, মূলনীতি প্রণয়ন করা হবে, সেখানে সব অংশীজনকে সঙ্গে নিয়ে অনলাইনে অধিকার রক্ষার জন্যও একটি ‘গঠনতন্ত্র’ প্রণয়ন করতে হবে।

বর্তমান বিশ্বে ‘নজরদারি পুঁজিবাদ’ নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও বিগ ডেটার যুগে নজরদারি পুঁজিবাদ আমাদের অধিকার খর্ব করছে কি?

সাইমুম রেজা: বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হলো উপাত্ত। বলা হয়ে থাকে, উপাত্ত যার হাতে, ক্ষমতাও তার হাতে। এর প্রমাণ হলো বিশ্বের সবচেয়ে সম্পদশালী ১০টি কোম্পানির অধিকাংশই হলো প্রযুক্তি কোম্পানি, যেমন মেটা, অ্যাপল, অ্যামাজন, টেসলা, নেটফ্লিক্স ইত্যাদি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রযুক্তির মাধ্যমে ক্রমাগত তারা আমাদের প্রায় সব ধরনের তথ্য নিয়ে নিচ্ছে, যেটাকে আমরা বলি বিগ ডেটা। বর্তমানে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো যত পারছে, তত আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে নিচ্ছে। কারণ, তারা জানে, আমাদের এসব ব্যক্তিগত তথ্য আজ না হলেও কাল তারা অন্য কোনো কোম্পানি বা সরকার বা ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাছে বিক্রি করতে পারবে। এভাবে আমাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার বিনিময়ে একটি বৈশ্বিক নজরদারি পুঁজিবাদ গড়ে উঠেছে। দার্শনিক ও সমাজ মনস্তাত্ত্বিক সোশানা জুবফ তাঁর বিখ্যাত দ্য এজ অব সার্ভিল্যান্স ক্যাপিটালিজম বইয়ে লিখেছেন, আমাদের আচরণ উপাত্ত (বিহেভিয়ারাল ডেটা) এসব প্রযুক্তি কোম্পানির জন্য আচরণ উদ্বৃত্ত (বিহেভিয়ারাল সারপ্লাস) তৈরি করে, যা ভবিষ্যতে বিপুল মুনাফার বিনিময়ে বিক্রি করা হতে পারে। সমস্যা হলো কোনো কর্তৃত্ববাদী ও অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আমাদের এসব ব্যক্তিগত তথ্য দেদার বিক্রি হলে তাতে শুধু আমাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তাই বিঘ্নিত হবে না, গণতান্ত্রিক পরিবেশও হুমকির মুখে পড়বে।

আপনাকে ধন্যবাদ।

সাইমুম রেজা: আপনাদেরও ধন্যবাদ।

Mr. Md. Saimum Reza Talukder is currently serving as the Senior Lecturer, School of Law, BRAC University, Bangladesh. He is an enrolled lawyer at the Bangladesh Bar Council and a member of the Dhaka District Bar Association. Mr. Saimum has completed LL.M. and LL.B. from the University of Chittagong, Bangladesh and holds a specialized Master’s degree in Law and Digital Technologies from Leiden University, Netherlands. He also obtained a Postgraduate Diploma in Social Innovation in a Digital Context (SIDC) from Lund University, Sweden. Mr. Saimum also holds a Diploma in “Economic, Social and Development Rights (ESDR)” from the Kathmandu School of Law.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Leave a comment
scroll to top