Close

যথাযথ সূত্রবিহীন একটি ছবি যেভাবে ডিসইনফরমেশনের উৎস হয়ে উঠলো

তবে এই পুরো ঘটনাটি এবং এটিকে কেন্দ্র করে সাধারণ পাঠকদের মাঝে তৈরি হওয়া দ্বিধাদ্বন্দ্বের ও বিতর্কের মূলে রয়েছে সংবাদমাধ্যম কর্তৃক একটি ছবির যথাযথ সূত্র উল্লেখ না করে তা প্রকাশ করা। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে এমন অনুশীলন প্রায়ই দেখা যায়।

গতকাল ২৮ মার্চ গ্লোবাল ডিসইনফরমেশন ইনডেক্স (জিডিআই) এবং বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইট লিমিটেড (ডিআরএল) যৌথভাবে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

“Disinformation Risk Assessment: The Online News Market in Bangladesh” শীর্ষক রিপোর্টটিতে খতিয়ে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের মূলধারার সংবাদমাধ্যমের ওয়েবসাইটগুলোতে ডিসইনফরমেশন বা কুতথ্য প্রকাশিত হওয়ার ঝুঁকি কতটুকু রয়েছে।

৩৩টি সংবাদমাধ্যমের ওয়েবসাইটের ওপর চালানো গবেষণাটির ফলাফল বলছে, সবগুলো ওয়েবসাইটই ডিসইনফরমেশ ছড়ানোয় ভূমিকা রাখার ঝুঁকিতে আছে। এর মধ্যে ১৭টি ওয়েবসাইট ‘মধ্যম ঝুঁকি’ এবং ১৬টি ‘উচ্চ ঝুঁকি’র মধ্যে রয়েছে।

পুরো গবেষণা প্রতিবেদনটি পড়ুন এখানে

৩৩টি ওয়েবসাইটের ৭ শতাধিক প্রতিবেদনকে ১০টি বিষয়ের আলোকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এর মধ্যে দেখা গেছে বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যমের কন্টেন্টে সবচেয়ে বেশি দুর্বলতা রয়েছে (তথ্য/ছবি/ভিডিওর) সূত্র উল্লেখ করা বা এট্রিবিউশনের ক্ষেত্রে।

কোন সংবাদ প্রতিবেদনে দেয়া তথ্য, ছবি বা ভিডিওর সূত্র যথাযথভাবে উল্লেখ না করা এবং কারো বক্তব্য যথাযথভাবে এট্রিবিউট না করার কারণে কিভাবে ডিসইনফরমেশন (কুতথ্য) বা মিসইনফরমেশন (অপতথ্য) ছড়ানোর ঝুঁকি তৈরি করে তার একটি দৃষ্টান্ত এই লেখায় দিতে চাই।

কাকতালীয়ভাবে এই রিপোর্ট প্রকাশের একদিন আগে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক প্রথম আলোর একটি ছবি– যা যথাযথ সূত্রসহ প্রকাশিত হয়নি– দেশের অনলাইন স্পেস, এমনকি মিডিয়াতে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

কিভাবে প্রথম আলোর যথাযথ সূত্রহীন ছবিটি মিসইনফরমেশন এবং ডিসইনফরমেশন ছড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছে তা আমরা এখন দেখবো।

প্রথম আলো গত ২৬ মার্চ “আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগব” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সাথে ছিল একটি ছবি যেটিতে দেখা যায়, জাতীয় স্মৃতিসৌধের গেইটের বাইরে ফুল হাতে দাঁড়িয়ে সৌধের দিকে তাকিয়ে আছে একটি শিশু।

প্রতিবেদনের সাথে ছবিতে ক্যাপশনে লেখা ছিল: “সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধের দর্শণার্থী বেশি এলে ফুল বিক্রি বাড়ে সবুজ মিয়ার। এজন্য স্বাধীনতা দিবসের অপেক্ষায় আছে এই শিশু। শুক্রবার দুপুরে স্মৃতিসৌধের মূল ফটকে। ছবি: প্রথম আলো”।

মূল প্রতিবেদনের স্ক্রিনশট:

এরপর প্রথম আলো তাদের ফেসবুক পেইজে একটি পোস্টার শেয়ার করে যেখানে ওই শিশুর ছবি রয়েছে এবং ছবির নিচে উদ্ধৃতি হিসেবে জাকির হোসেন নামের এক দিনমজুরের বক্তব্য জুড়ে দেয়া হয়েছে।

উদ্ধৃতিটি হলো: “পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়া কী করুম। বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগব।”

পোস্টারটিতে বলা হয়নি যে, ছবির শিশুটির নাম জাকির হোসেন। আবার এটাও স্পষ্ট করা হয়নি যে, ছবির শিশুটির নাম (দিনমজুর) জাকির হোসেন নয়, বরং ফুল বিক্রেতা মো. সবুজ, যা মূল প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবেই উল্লেখ রয়েছে।

সাংবাদিকতায় কোন ছবি প্রকাশের আদর্শ নিয়ম হচ্ছে, সেটির একটি ক্যাপশন থাকা। সেই ক্যাপশনে মৌলিক কিছু তথ্য; যেমন, দৃশ্যটি কোথায় এবং কবে তোলা, তাতে দৃশ্যমান বিষয়/ব্যক্তির বর্ণনা বা পরিচয়, এবং ফটোগ্রাফারের নাম ইত্যাদি থাকতে হয়।

প্রথম আলোর ফেসবুকে শেয়ার করা পোস্টারে এই নিয়মটি মানা হয়নি (যদিও মূল প্রতিবেদনে ব্যবহৃত ছবিতে তা যথাযথভাবে মানা হয়েছে)। ফলে, যারা মূল প্রতিবেদন পড়েননি তাদের কাছে পোস্টারে থাকা শিশুর ছবির নিচে থাকা টেক্সটকে ‘ক্যাপশন’ হিসেবে ধরে নিয়ে ওই শিশুকে জাকির হোসেন মনে করাটা খুবই স্বাভাবিক।

একটি ছবির সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য ক্যাপশনে তুলে না ধরা এবং আরেকজন ব্যক্তির উদ্ধৃতি সাবধানতার সাথে উপস্থাপিত না হওয়ায় পাঠকের কাছে ভুল বার্তা যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

প্রথম আলো তাদের এই ভুল স্বীকার করে নিয়ে ফেসবুকের পোস্টারটি সরিয়েছে।

অবশ্য পত্রিকাটি আরও বাড়তি উদ্যোগ নিয়ে মূল প্রতিবেদনে যথাযথ ক্যাপশনসহ সঠিকভাবে উপস্থাপিত সবুজের ছবিটিও বাদ দিয়ে শিরোনাম পরিবর্তন করে প্রতিবেদনের নিচে সংশোধনী যুক্ত করেছে।

সংশোধনীতে বলা হয়েছে: “প্রথমে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনের শিরোনাম এবং ব্যবহার করা ছবির মধ্যে অসঙ্গতি থাকায় ছবিটি তুলে নেওয়া হয়েছে এবং শিরোনাম সংশোধন করা হয়েছে। শিরোনামে উদ্ধৃত বক্তব্য ছবিতে থাকা মো. সবুজের ছিল না, ছিল দিনমজুর জাকির হোসেনের। একই কারণে সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়া পোস্টও প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে।”

প্রথম আলোর আরেকটি অযথার্থ কাজ ছিল, প্রতিবেদন প্রকাশ এবং সংশোধনী যোগ করার মাঝখানে বেশ কিছুক্ষণ সময়ের জন্য প্রতিবেদনটি অপ্রকাশিত করে রাখা। সাংবাদিকতার স্ট্যান্ডার্ড অনুশীলনে কোন খবরকে যথাযথ ব্যাখ্যা ছাড়া ‘কিল’ করা (সেটা সাময়িক সময়ের জন্য হলেও) অত্যন্ত অপেশাদার আচরণ বলে বিবেচিত হয়।

প্রতিবেদন সংশোধনের পর এই একই ছবিকে কেন্দ্র করে একটি প্রচারণা শুরু হয়েছে যেখানে দাবি করা হচ্ছে “প্রথম আলোর সেই ছবি পুরোটাই ভুয়া“। আবার কোথাও বলা হয়েছে প্রথম আলোর “প্রতিবেদনটি মিথ্যা“।

একাত্তর টিভি তাদের ওয়েবসাইটে একটি প্রতিবেদন (এবং টিভিতেও) করেছে যার শিরোনাম “স্বাধীনতা দিবসে প্রথম আলোর সেই ছবি পুরোটাই ভুয়া”।

প্রতিবেদনটির এক জায়গায় লেখা হয়েছে: “সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধের প্রধান ফটকে গিয়ে ছবিটি দেখাতেই সবাই ছবির শিশুকে চিনতে পারলো। তবে, নাম ভুল ছেপেছে দৈনিক প্রথম আলো। শিশুটির নাম জাকির নয়, সবুজ।”

প্রকৃতপক্ষে প্রথম আলো তাদের প্রতিবেদনের কোথাও শিশুটির নাম ‘জাকির’ বলেনি। বরং মো. সবুজ নামের শিশুটি এবং দিনমজুর জাকির হোসেন– এই দুইজনের পরিচয় এবং বক্তব্য আলাদাভাবে প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছে পত্রিকাটি।

কিন্তু ফেসবুকে প্রকাশ করা পোস্টারে মো. সবুজের ছবির নিচে যথাযথভাবে ক্যাপশন না দিয়ে জাকির হোসেনের উদ্ধৃতি ব্যবহার করায় বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।

ফলে, প্রথম আলো “নাম ভুল ছেপেছে” বা “শিশুটির নাম জাকির” ছেপেছে দাবি করাটা অসত্য। আলোচ্য ক্ষেত্রে এটিই ডিসইনফরমেশন।

সময় টিভি তাদের এই প্রতিবেদনে লিখেছে: “…প্রথম আলোর এ মিথ্যা প্রতিবেদনটির বিষয়ে অনুসন্ধানে নামে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল একাত্তর টিভি। অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রতিবেদনটি সম্পূর্ণ সাজানো গল্প। এটি প্রতিবেদনটি করা হয়েছে সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভুল তথ্য দিয়ে।”

এক্ষেত্রেও সময় টিভির দাবিটি অসত্য। কারণ, প্রথম আলো সবুজকে জাকির হোসেন বলে দাবি করেনি। আর সংবাদ প্রতিবেদনে একটি ছবির অসঙ্গতিপূর্ণ ব্যবহারের কারণে পুরো একটি প্রতিবেদনকে ‘মিথ্যা’ ‘সাজানো গল্প’ ইত্যাদি শব্দে অভিহিত করা পেশাদার সাংবাদিকতার অনুশীলন নয়।

তবে এই পুরো ঘটনাটি এবং এটিকে কেন্দ্র করে সাধারণ পাঠকদের মাঝে তৈরি হওয়া দ্বিধাদ্বন্দ্বের ও বিতর্কের মূলে রয়েছে সংবাদমাধ্যম কর্তৃক একটি ছবির যথাযথ সূত্র উল্লেখ না করে তা প্রকাশ করা। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে এমন অনুশীলন প্রায়ই দেখা যায়।

সংবাদ প্রতিবেদনে ব্যবহৃত প্রতিটি তথ্য, ছবি ও ভিডিওর যথাযথ সূত্র উল্লেখ করা এবং কারো বক্তব্য উদ্ধৃত করার ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন ডিসইনফরমেশন এবং মিসইনফরমেশন নিয়ন্ত্রণের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়।

Qadaruddin Shishir is a pioneering fact checker in Bangladesh and currently he is the Bangladesh Editor for AFP Fact Check. In his six years of fact checking career, Shishir was the key person in founding three different fact checking initiatives in the country. He authored (2022) ‘The Fact Checking and Verification Handbook’ in Bengali. He is an OSINT trainer for Google News Initiative and the Asian American Journalist Association and also worked for Asia Foundation, the Press Institute of Bangladesh (PIB) and the MRDI.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Leave a comment
scroll to top