আইএমএফ এর সাথে অংশীদারিত্বের কালেই টানা ২২ মাস থেকে বাংলাদেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলছে, দেশের অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে গভীরতর হচ্ছে। আর্থিক হিসাবের ঘাটতি দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ ৯.২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। বিদ্যুৎ,এভিয়েশন, জ্বালানি সহ জরুরি আমদানি, বিভিন্ন ডিজিটাল সেক্টর ইত্যাদি বহু খাতে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার বিল বকেয়া রেখেই নিট রিজার্ভ মাত্র ১৩ বিলিয়নে নেমে এসেছে, যা নয় রিজার্ভের বছর আগের স্থিতি। আমদানিতে ডলার জোগান এবং ডলারের বিল পরিশোধের সংকট চলছে বিগত দেড় বছর ধরে, এসময় এলসির উপর মানহীন নিয়ন্ত্রণ আরোপে দেশে ব্যবসা ও কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারের টাকা ক্রাইসিসেও ভুগছে। সার বিদ্যুৎ সহ বিভিন্ন খাতের পাওয়া টাকায় পেমেন্ট দিতে না পেরে সরকার প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকার এরিয়ার বন্ড ইস্যুর পরিকল্পনা করেছে। নতুন বিদেশী ঋণ ও বিভিন্ন সহায়তার প্রায় অর্ধেকই যাচ্ছে বিগত এক যুগে নেয়া বাছবিচারহীন ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধে। সরকার হুন্ডি কিংবা পাচার থামাতে ব্যর্থ, ব্যর্থ অতি বাড়ন্ত খেলাপি ঋণে প্রকৃত লাগাম টানতে, ব্যাংকিং খাতে আস্থা ফেরাতে। দেশ এসময়ে টাকার মান ইতিহাসের সর্বোচ্চ পতন দেখেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, আইএমেফের সাথে অংশীদারিত্বের পরেও এসব কেন হচ্ছে?
আমি পাঁচটি কারণকে দায়ী বলে মনে করি। এক- ভুল সময়ে ভুল পলিসির বাস্তবায়ন। দুই- সরকারের লার্জ স্কেলের পরিসংখ্যান জালিয়াতিকে আমলে না নেয়া। তিন- স্থানীয় পলিটিকাল ইকোনোমিকর গবেষণা ভিত্তিক পলিসি প্রপোজাল না করা। চার- কর্তৃত্ববাদী সরকারের রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন এবং প্রাতিষ্ঠানিক অক্ষমতার সাথে সংস্কার পলিসির সংযোগ না টানা এবং সর্বোপরি, পাঁচ-আইএমএফের ছাড় দেয়ার মানসিকতা । সম্পূরক প্রশ্ন হচ্ছে, দেউলিয়া হওয়ার মাত্র ছয়-নয় মাসের মধ্যেই শ্রীলঙ্কা সামস্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফেরাতে হলেও বাংলাদেশ আইএমএফ এর সাথে এঙ্গেইজ হবার পরেও পারছে না কেন?
১ম কিস্তি ছাড়ের একবছর গত হলেও টানা ২২ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি অনিয়ন্ত্রিত, ডলারের বাজার অস্থির, রিজার্ভের পতন চলছে। ব্যাংকিং তারল্য সংকট, মালিকানা হস্তান্তর, দুর্বল ব্যাংক গুলোর মার্জার সমস্যা, খেলাপি ঋণ সংকটের কুল কিনারা হচ্ছে না। ব্যাংকিং দুর্বৃত্তায়ন অব্যাহত আছে। সংকটেও সরকারের পরিচালনা ব্যয়ে সংকোচন আসেনি। বাজেট ঘাটতি কমানো হয়নি, সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণ থামেনি (ব্যাংক ঋণ, সঞ্চয়পত্র ঋণ, অর্থ ছাপানো, ডোভল্ভমেন্ট সব সব ফর্মের মিলিত ঋণ)। অর্থবছরের তিন প্রান্তিকের শেষে বার্ষিক উন্নয়ন বাজেটে বাস্তবায়ন মাত্র ত্রিশ শতাংশের ঘরে থমকে ছিল। রাজস্ব আয় দিয়ে সরকার উন্নয়ন কাজ বাদ দিয়ে শুধু পরিচালনা ব্যয়ে ব্যস্ত। সুশাসন এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ফেরাতে আইএমএফ নেগোসিয়েশনের প্রভাব দৃশ্যমান নয়। গুরুত্বপূর্ণ অবজারভেশন হচ্ছে সংস্কার প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়নের সিকুয়েন্স বা অর্ডার বেশ কিছু ক্ষেত্রে ভুল।
ক্রলিংপেগ পদ্ধতি বাস্তবায়নের (অন্তত দেড় বছর আগে করা উচিৎ ছিল) মাধ্যমে ডলারের দাম পড়তে দেওয়া হয়েছে ভুল সময়ে। ৬-৯ সুদের হার বেড়ে দ্বিগুণ যাবার পরেও নতুন দফা নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে। সিকুয়েন্স না মেনে ‘সাডেন শকে’ যাওয়া হয়েছে।
ডলারের একক রেট সময় মত বাস্তবায়ন করা হয়নি। ডলারের বিপরীতে টাকায় ক্রয়ক্ষমতা মান বা ‘আরইইআর(REER) এর কাছাকাছি নেয়া হয়নি সঠিক সময়ে। অন্তত একবছর পরে এসে টাকার মান এক লাফে ৬.৩% পড়তে দেয়ায়, টাকার অংকে বৈদেশিক ঋণের মোট স্থিতি বেড়ে গেছে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা (প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার)। ডলারের দাম ৭ টাকা বৃদ্ধিতে সরকারের মূল বোঝা বিদ্যুৎ খাতের ক্যাপাসিটর চার্জ, সার ও জ্বালানি সহ যাবতীয় আমদানি এবং বিশেষভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। ফলে দেশ নতুন দফা মূল্যস্ফীতি প্রত্যক্ষ করবে।
আমানত-সঞ্চয়ে সুদের হারও মূল্যস্ফীতির কাছাকাছি নেয়া হয়নি সঠিক সময়। ঋণের সুদহার নির্ধারণে তথাকথিত স্মার্ট পদ্ধতি চাপিয়ে দিয়ে দুই অংকের মূল্যস্ফীতির কালে এক অংকে ঋণ বিতরণ করে বড় শিল্পপতিদের পুরানো ঋণ ফিরিয়ে নতুন ঋণ দেয়ার উইন্ডো তৈরি করা হয়েছে, এতে ঋণ অদলবদল হয়েছে। ‘ক্যাপিটাল ফ্লাইট’ বা পাচার বেড়েছে কিন্তু নতুন বিনিয়োগ হয়নি। ব্যাংকিং খাতে বড় বড় ঋণ জালিয়াতি হয়েছে। দীর্ঘ সময় সঞ্চয়কারীদের ঠকানো হয়েছে বলে তারল্য সংকটও দীর্ঘায়ত হয়েছে।
আইএমএফ শর্তে এক অংকের খেলাপি কথা বলা হয়েছে, সেটা বাস্তবায়নে সরকার আবারো ভয়ানক সব দুর্বৃত্তায়নের আশ্রয় নিয়েছে। ঋণ পুনঃ তফশিল (রিসিডিউল), রাইট অফ, প্রভাবশালীদের সুদ মাফ করা হচ্ছে বিলিয়ন ডলার পর্যায়ে। আইএমএফ এনগেজ থাকা অবস্থাতেই নতুন করে ব্যাংকিং মালিকানা বেহাত হয়েছে (ন্যাশনাল ব্যাংক)। খেলাপি ঋণ ফেরানোর উদ্যোগ না নিয়ে, শাস্তি না দিয়ে, উল্টো তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোকে দিনে ৫ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা বা এরও বেশি ধার দেয়ার মত ঘটনা ঘটেছে একাধিক বার। বিগত ছয় মাসে অন্তত দুটি প্রভাবশালী শিল্প গ্রুপকে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা ঋণ মওকুফ করেছে জনতা ব্যাংক। এইসবে আইএমএফের সুস্পষ্ট কোন চাপ দেখা যায়নি। অংশীদারিত্বের এক বছরেই সরকারি ব্যাংক গুলোর (সোনালি, জনতা, অগ্রণী ও রুপালি) খেলাপি ঋণ ২৭% বেড়ে প্রায় ৬৩ হাজার কোটি টাকা হয়েছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, ১ম ও ২য় কিস্তি ছাড়ের পরেও ১ বছরে শীর্ষ কোন ঋণ খেপালিকে আইনের আওতায় আনার ঘটনা ঘটেনি। ফলে বুঝাই যাচ্ছে আইএমএফ সামস্টিক অর্থনীতির মৌলিক সমস্যার ‘রুট-কজ’ সমাধান করতে কাজ করছে না। দুর্বৃত্তায়ন ও সুশাসনের আসল কাজ না করে ফুটো চৌবাচ্চায় পানি ঢালছে। উপরন্তু সামস্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বা ম্যাক্রো ইকোনমিক স্টেবিলিটি ফেরানোর মৌলিক উপাদান গুলোতে হাত দেয়ার আগেই, ভর্তুকি কমানোর নাম করে ‘স্টেট ওয়েলফেয়ার এক্সপেন্ডেচার’ বা ভর্তুকি কমানোতে এমন সব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে যাতে শুরুতেই মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেছে।
অর্থাৎ ৬-৯ সুদের হার ও নীতিসুদহার বাড়ানো, অর্থ পাচার বা ক্যাপিটাল ফ্লাইট বন্ধ, রিজার্ভ মানি ইঞ্জেক্ট বা টাকা ছাপানোর বন্ধ, লোকসানি সরকারি কোম্পানি এবং বেসরকারি দুর্বৃত্ত কোম্পানির অনুকূলে বন্ড ইস্যু অর্থাৎ ক্যাপিটাল ফ্লো মেশিনারি/মেকানিজম বন্ধ করার সুস্পষ্ট পদক্ষেপের আগেই মূল্যস্ফীতি বন্ধের গণ-বিরোধী পদক্ষেপ এসেছে। এঞ্জেইজমেন্টের শুরু থেকেই ক্রমাগত বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়াতে (নভেম্বর ২০২২, জুন ২০২৩, জানুয়ারি-এপ্রিল ২০২৪), আমদানিতে শুল্ক ও কর ছাড় হ্রাসে ক্রমাগত চাপ এসেছে। শূন্য ভর্তুকির মিশনে বিদ্যুৎ-জ্বালানির মূল্য এসময়ে অন্তত আট দফা বৃদ্ধি করে মানুষের জীবনযাত্রাকে অস্থিতিশীল করেছে। সাথে চলছে আমদানিতে শুল্ক ছাড় বন্ধ, রেস্ট্রিক্টিভ ডিউটি (আরডি) বৃদ্ধি ও ভ্যাট বৃদ্ধির প্রক্রিয়া। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি তৈরির চার-পাঁচটি বড় বড় এলিমেন্টকে একসাথে প্রপেল করা হয়েছে যা মানুষকে নতুন দারিদ্রের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
নতুন দারিদ্র্য তৈরি হচ্ছে, বিশেষভাবে নগর দারিদ্র্য এবং জ্বালানি দারিদ্র্য গরিব ও মধ্যবিত্ত জীবনকে বিষিয়ে তুলেছে। এসময় কৌশলগত অর্থনৈতিক পণ্য হিসেবে সার, ডিজেল এবং বিদ্যুতের দাম বেড়ে কৃষি ও কৃষি উপখাতের উৎপাদন মূল্য ব্যাপক বেড়ে ক্ষুধা ও পুষ্টির সংকট সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে বিগত ৬ মাস বিদ্যুৎ এবং গ্যাসসহ প্রাথমিক জ্বালানির দাম স্থিতিশীল কিংবা কমছে বলে, আইএমএফের চাপে চলমান উচ্চমূল্যের মধ্যেও জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম না কমিয়ে, উল্টো বাড়ানর প্রক্রিয়াটি স্ববিরোধী। বাংলাদেশের চলমান মূল্যস্ফীতি নভম্বের’২২ থেকে জুলাই’২৩ সময়কালে জ্বালানির মূল্য ২ দফায় প্রায় ৬২ শতাংশ বাড়ানোর পর থেকেই শুরু।
পলিসিগত ধারাবাহিকতা হীনতা এবং প্রত্যক্ষ দ্বিচারিতা বাংলাদেশের ম্যাক্রো ইকনোমিক স্টেবিলিটি নিশ্চিত করবে না বলেই আশংকা আছে। একসাথে মূল্যস্ফীতি তৈরির সবগুলো এক্সেলারেটরে চাপ দেয়া যায় না, এখানে যৌক্তিক সিকুয়েন্স এবং অর্ডার মানা চাই।
ক্রলিংপেগ পদ্ধতিতে ভুল সময়ে টাকার অবমূল্যায়নে মূল্যস্ফীতির লাগাম আসবে না। কেননা- ক। গত দুই বছরে ‘নিউ মানি ইনজেকশনের’ প্রভাবে মূল্যস্ফীতি চলবে অর্থাৎ ছাপানো রিজার্ভ মানির গুণ-প্রবাহ (ফ্লো ইফেক্ট) চলছে। খ। মানহীন এলসি নিয়ন্ত্রণে মূল্যস্ফীতি চলবে। (দরকারি এলসি বন্ধ, বেদরকারি এলসি প্রসেস হচ্ছে)। বেসরকারি ব্যাংকের এলসির ক্লোজিং ডলাররেট আগেই ১১৭ থাকলেও প্রভাবশালীরা কিন্তু সরকারি ব্যাংকের ১১০ ভোগ করছিল,ফলে বর্ধিত আমদানি ব্যয় মূল্যস্ফীতি বাড়াবে। গ। বছরে চারবার করে তিন বছরে বিদ্যুৎ এর ১২ দফা মূল্যবৃদ্ধির পরিকল্পনায় মূল্যস্ফীতি বাড়বে। ঘ। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির সকল যৌক্তিক এক্সপেকটেশনেও বাজারে মূল্য বাড়াবে।
বিদ্যুৎ-খাতকে কেন্দ্র করে আইএমএফের ভর্তুকি কমানোর পলিসি ব্লেন্ডার ঘটাচ্ছে, পলিসিগুলো গবেষণা ভিত্তিক নয়। বাস্তবে জ্বালানিতে বাংলাদেশ বিলিয়ন ডলার আয় করছে। বিদ্যুৎ-খাতের ভর্তুকি রাজনৈতিকভাবে দুর্বৃত্তায়িত বড় পরিসরের দুর্নীতি, ক্যাপাসিটর চার্জ, ত্রুটিপূর্ণ বিদ্যুৎকেন্দ্র, জ্বালানি অদক্ষ বিদ্যুতকেন্দ্র, মেয়াদুত্তীর্ণ বিদ্যুতকেন্দ্র নবায়ন এবং সিস্টেমলসের মিলিত ফল। ২০২৩ সালের ইউনিট প্রতি উৎপাদনের সরকারি তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২৩-২৫% বিদ্যুৎ উৎপাদন ইউনিট যান্ত্রিক ত্রুটিতে অচল হয়েও ক্যাপাসিটর চার্জ ও ওভারহোলিং চার্জ হিসেবে ভর্তুকি পায়। আরও প্রায় ২৫ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র জ্বালানির কারণে অনুতপাদনশীল থেকেও ভর্তুকি পায়। মোট ৪০% বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা অলস থেকেও বিদেশ থেকে বিলিয়ন ডলারের বিদ্যুৎ কিনে ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে। মূল সমস্যা সমাধানে না হেঁটে এবং ভর্তুকির মূল কারণ বন্ধ না করে, একতরফা ভর্তুকি কমানোর চাপ না থাকায় আইএমএফের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মূল্য বৃদ্ধি কোন ফল দিচ্ছে না। আইএমএফ ঋণের উল্লেখযোগ্য অংশই দুর্নীতির খেসারতে ব্যয় হচ্ছে। শর্তের বেড়াজালে ব্যয় বেড়ে জীবনযাত্রা ঠিকই দুর্বিষহ হয়েছে।
আইএমএফের সাথে এঙ্গেজমেন্টের এই এক-দেড় বছরে এখনো পর্যন্ত সরকার এলসি কোয়ালিটি কন্ট্রোল নিশ্চিত করতে পারছে না, এখনো প্রভাবশালীরা এবং সরকারের বিভিন্ন সংস্থা সত্য-মিথ্যা এলসি করে অর্থ পাচার করছে, আন্ডার ও ওভার ইনভয়েসিং এর খবর নিয়মিতই পত্রিকায় আসছে। কিন্তু সাধারণ আমদানিকারকরা ট্রেডিং পণ্য, শিল্পের মূলধন এবং কাঁচামাল আমদানিতে হিমশিম খাচ্ছেন ডলার সংকটে।
আইএমএফের পলিসিতে ছাড়ের মানসিকতা প্রবল। ২য় কিস্তির সময় বাংলাদেশ ৩টি প্রধান শর্ত (ডলার রেট, রিজার্ভ এবং খেলাপি ঋণের শতাংশ) পূরণে ব্যর্থ থেকেও কিস্তি ছাড় পেয়েছে, অথচ একই কারণে অন্যদেশে কিস্তি ছাড়ে বিলম্ব করেছে। ডলার সংকটেও বাংলাদেশ আমদানি সংকোচন করেও ফরেন ডেবট সার্ভিসিং (বৈদেশিক ঋণের সুদ-আসল পরিশোধ) নিয়মিত রেখেছে, হতে পারে সেজন্য আইএমএফ এখানে নিজের পলিসিতে ফ্লেক্সিবিলিটি এনে, সরকারের শর্তে এডজাস্ট করে ‘ল্যান্ডিং বিজনেস’ করার প্রকল্প নিয়েছে। ৩য় কিস্তিতে উল্টো আইএমএফ জুন’২৪ রিজার্ভ লক্ষ্যমাত্রা ২০.১০ বিলিয়ন ডলার থেকে কমিয়ে ১৪.৭৭ বিলিয়ন করেছে। শুধু তাই নয়, সরকারের অনুরোধ মেনে আইএমএফ রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রাও কমিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, আইএমএফ কি পর্যাপ্ত গবেষণা ও প্রস্তুতি নিয়ে আসেনি? নাকি বাংলাদেশ মিশনে কাজ করা টিমটিতে পর্যাপ্ত এক্সপার্ট নেই!
বাংলাদেশের বড় সমস্যা তথ্য জালিয়াতিতেও আইএমএফ নির্বিকার। আইএমএফ স্ট্যাডি মতেই প্রকৃত খেলাপি ঋণ সরকারি সংখ্যার দ্বিগুণ। জনসংখ্যার তথ্যে সমস্যা আছে বলে মাথাপিছু আয়ের তথ্যেও বিভ্রাট আছে। টাকার নতুন বিনিময় মূল্য হারে (৬.৩% পতন) জিডিপির ডলার ভ্যালু এডজাস্ট করবে কিনা এই প্রশ্নের উত্তর নেই! দেড় বছরে টাকার মূল্য ২৫% কমেছিল, ডলারে জিডিপির আকার এডজাস্ট হয়নি! বলা হয়, বিবিএস স্থির মূল্য জিডিপি বা রিয়েল জিডিপির হিসেব টাকাতেই করে, এখানে ইনফ্লাশন রেট দিয়ে চলতি মূল্যকে স্ফীত করা হয় বিধায় টাকার অংকে জিডিপি সম্পূর্ণ ইনফ্লাশনমুক্ত হয়। অথচ গত এক বছরে ইনফ্ল্যাশন সাড়ে ৯ শতাংশ কিন্তু টাকার ডলার রেটে অবনমন ২৫%। সুতরাং ডিফ্লেট (টাকার অংকে মূল্য সমন্বয়) করার পরেও ডলারের নতুন বিনিময় ভ্যালিতে রূপান্তরের পরে স্থির মূল্যের জিডিপির আকার কমার কথা! দেড় বছরে টাকার মূল্যমান প্রায় ৩০ শতাংশ কমলেও সরকার ঠিকই ডলারের হিসেবে মাথাপিছু আয় বাড়িয়েই চলেছে। এভাবে তথ্য জালিয়াতি বন্ধ থেকে শুরু করে সামস্টিক অর্থনৈতিক স্থিতি কিছুই অর্জিত হচ্ছে না, কিন্তু দেশের বৈদেশিক ঋণের বোঝা ঠিকই বাড়ছে।
বিআইডিএস নিজদের সাম্প্রতিক এক জরিপে খাদ্য মূল্যস্ফীতি পেয়েছে ১৫ শতাংশ। অথচ বিবিএস এপ্রিলেও খাদ্য মূল্যস্ফীতি দেখাচ্ছে ১০.২২ শতাংশ। দুই জরিপে ডেভিয়েশন ৪৬.৭৭%। তথ্য জালিয়াতি বিচারবিবেচনার সব মাত্রা ছাড়িয়েছে। ম্যাক্রো ইকোনোমিক স্ট্যাবিলিটি ফেরানোর অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ গুরুত্বপূর্ণ। মূল্যস্ফীতির তথ্যই যেখানে জালিয়াতিপূর্ণ, সেখানে তথ্য সন্ত্রাস না শুধরে প্রস্তাবিত আইএমএফ সংস্কার পলিসি গুলোর কার্যক্ষমতা কি প্রশ্ন-যুক্ত নয়!