Close

বাংলাদেশের জন্য একটি অশনি সংকেত

যতক্ষণ না পর্যন্ত এই সৎ স্বীকৃতি মিলছে না যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি ভেঙে পড়ছে এবং সেটার পুনর্গঠনের প্রাথমিক ধাপ হিসেবে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রয়োজন, ততক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশকে এই অশনি সঙ্কেত ধাওয়া করবে।

৭৫ বছর আগের আগস্ট মাসের এক উষ্ণ রাতে ব্রিটিশ রাজের সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। এই বিচিত্র প্রত্যুষের পথে প্রথমে দুটো, পরে তিনটি দেশের আবির্ভাব ঘটেছিল। অন্নদাশংকর রায়ের জবানিতে বলতে গেলে, এটা কেবল দেশ ও প্রদেশকেই ভাগ করেনি, বরঞ্চ চা বাগান, কয়লাখনি, কলেজ, থানা, অফিস থেকে শুরু করে চেয়ার, টেবিল, ঘড়ি, পিয়ন, পুলিশ ও অধ্যাপক সবকিছুকেই ভাগ করেছিল। এর সাথে যুক্ত হয়েছিল মানবেতিহাসের অন্যতম বৃহত্তম অভিবাসন/স্থানচ্যুতের ঘটনা।

২০০৮ সালে প্রশান্ত ভরদ্বাজ ও তার সহকর্মীরা ‘The Big March: Migratory Flows after the Partition of India’ শিরোনামের প্রবন্ধে অনুমান করা হয় যে, প্রায় ৩ মিলিয়ন হিন্দু তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে দেশান্তরিত হয়েছিলেন, অন্যদিকে এক মিলিয়ের তিন-চতুর্থাংশ ভারত থেকে সেখানে এসেছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান থেকে চলে যাওয়া লোকের সংখ্যার বিপরীতে তুলনামূলক কম সংখ্যক লোকের আগমন উপমহাদেশের পূর্ব দিকের র‍্যাডক্লিফ রেখার দুই অংশের জনসাধারণের ভিন্নতর স্মৃতির সম্ভাব্য ব্যাখ্যা প্রদান করে। ভারতীয় বাংলার সাহিত্যে, ভিজুয়াল মিডিয়া, ধ্রুপদি সাহিত্য, সিনেমাতে পার্টিশন সর্বদা বিরাজমান, যেখানে একটি হারানো জগত, শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষের দুর্দশা এবং কলকাতার বিচিত্র জনপদে তাদের টিকে থাকার সংগ্রাম এর গল্প মিশে থাকে।

কিন্তু যারা থেকে গিয়েছিলেন এই পূর্বাংশে তাদের জিন্দেগী কেমন ছিল?

নিরদ সি চৌধুরী ও যতীন সরকার পূর্ববাংলা বা বর্তমান বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। যতীন সরকারের চেয়ে প্রায় চার দশকের বড় চৌধুরী ভারতের প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে তার আত্মজীবনী লিখেছিলেন এবং সুনাম কুড়িয়েছিলেন। সরকারও তার জীবনকাহিনী লিখেছিলেন; বাংলাদেশে প্রকাশিত বাংলা ভাষায় লেখা এই আত্নজীবনী কখনো ইংরেজিতে অনূদিতও হয়নি। বইটি সহজলভ্যও নয়। ফলে তিনিও অগোচরে রয়ে যান। এটা দুঃখজনক, কেননা এই ভূখণ্ড, অর্থাৎ তাদের জন্মভূমির প্রসঙ্গ উঠলে চৌধুরীর চেয়ে সরকার অনেক ভালো পথপ্রদর্শক হবেন।

যখন যতীন সরকারের দেশের বাড়ি ময়মনসিংহ জিন্নাহর পোকায় কাটা পাকিস্তানের পূর্বাংশের সাথে জুড়ে গেলো, তার পরিবার ভারতে চলে যাননি। এটা মোটেও অস্বাভাবিক ছিল না, কেননা প্রচুর হিন্দু পরিবার পূর্ব পাকিস্তানে থেকে গিয়েছিলেন। সম্ভবত এটি ছিল মহাত্মা গান্ধীর উপস্থিতি, অথবা এই বিশ্বাস যে, সুভাষ চন্দ্র বসু ১৯৫৭ সালে – ১৮৫৭ সালের বিপ্লবের একশ বছর এবং পলাশী যুদ্ধের দুই শত বছর পর – আবার ফিরে এসে বাংলা মাকে পুনরায় একত্রিত করবেন। কারণ যাই হোক না কেন, সেই ভয়াবহ আগস্টে কলকাতাগামী এবং কলকাতা হতে ছেড়ে আসা মৃতদেহ-ভর্তি কোনো ট্রেন ছিল না। বরঞ্চ বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন সময়ে দেশত্যাগের ঘটনা ঘটেছিল, বিশেষত ১৯৪৬, ১৯৫০ এবং ১৯৬৪ এর দাঙ্গাকালে বেশি হয়েছিল।

যতীন সরকার তাঁর পাকিস্তানের জন্ম-মৃত্যু দর্শন গ্রন্থে পূর্ব পাকিস্তানের মফস্বলে হিন্দু মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকদের জীবন বর্ণনা করেছেন। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট তিনি ভারতীয় হওয়া বন্ধ করলেও পাকিস্তানিও হয়ে যাননি। পাকিস্তান ইসলামি প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়, যেখানে হিন্দুরা সমান নাগরিক ছিলেন না। সংখ্যাগরিষ্টের ‘পবিত্র সুরক্ষা’র অধীনে তারা ছিলেন দিম্মি/জিম্মি। সরকার কখনোই পাকিস্তানি হতে পারেননি, এমনকি তাঁর বাঙালি মুসলমান প্রতিবেশিরাও পাকিস্তানকে তাদের বাড়ি বলে খুব একটা মনে করতে পারেননি। ১৯৭১ সালে যখন পূর্ব পাকিস্তান মরে গেলো, এবং বাংলাদেশের জন্ম হলো, তখন সরকার ভেবেছিলেন, তিনি এবার একটি মুক্ত দেশের সমান নাগরিক হবেন।

এবং কাগজে কলমে তিনি তা-ই হয়েছিলেন। বাংলাদেশ কখনোই ইসলামি প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়নি, যদিওবা সামরিক শাসক হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ আশির দশকে সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করেন; এবং তার রাজনৈতিক মিত্র এবং বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবিধানের অন্যান্য বিষয় পাইকারি হারে পরিবর্তন করলেও এটা প্রত্যাহার করতে অস্বীকার করেন। ধর্মের ব্যাপারে এখানে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য নেই। হিন্দুদেরকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চাকরি বাকরি, ব্যাংক থেকে লোন নেয়া বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া থেকে বঞ্চিত (কেবল ব্যতিক্রম মাদ্রাসা) করা হয় না। কাগজে কলমে যতীন সরকারের পাকিস্তানের ভূতদর্শন লেখার কোনো কারণ ছিল না; এই গ্রন্থ একটি হাইপোথেটিক্যাল সিক্যুয়েল যেখানে এমন কিছু নিয়ে কথা বলেছেন – যেমন হিন্দুদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা – যেগুলো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে দেখবেন বলে কেউ আশা করেননি।

সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বলতে ২০০২ সালে ভারতের গুজরাটে সংঘটিত সহিংসতার মতো কিছুকে বোঝানো হচ্ছে না – বাংলাদেশে কখনো এমন কিছু ঘটেনি। এটাও স্বীকার্য যে, উপমহাদেশের এই অংশের দুই বৃহৎ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যকার (এবং একাধিক এথনিক সম্প্রদায়) পারষ্পরিক উদাসীনতা ও অবিশ্বাস, প্রকট বৈরি রূপ ধারণ না করলেও, চিরন্তন সম্প্রীতির গল্পের চাইতেও অনেক বেশি জটিল। অন্নদাশঙ্কর রায় যেমন করে বলেছিলেন, এই অঞ্চলে দুই সম্প্রদায় কয়েক প্রজন্ম ও শতক ধরে সত্যিকারের কোনো মিলন ছাড়াই সহাবস্থানে ছিল। অবশ্য এটাও অস্বীকার করা অনুচিত হবে যে, ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারের জটিল মিথস্ক্রিয়া হিন্দু-মুসলমানের দৈনন্দিন ব্যক্তিক মেলামেশাকেও প্রভাবিত করেছিল।

যেমন, পুষ্কার মৈত্র ও সহকর্মীদের একটি দূর্দান্ত গবেষণাতে দেখান যে, ধর্মীয় পরিচয় নয় বরঞ্চ সংখ্যালঘু হিসাবে অবস্থান মানুষের আচরণকে প্রভাবিত করে করে। অর্থাৎ, পশ্চিমবঙ্গের একজন মুসলমান একজন হিন্দুর চেয়ে সহ-মুসলিম আরেকজনকে বেশি বিশ্বাস করেন; কিন্তু একজন বাংলাদেশি মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে উদাসীন থাকেন।

১৮ ও ১৯ শতকে এই দুই সম্প্রদায়ের বিচিত্র পথের ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারের অর্থনৈতিক পরিণাম আজতক বাংলাদেশে রয়েছে। সালমা আহমেদ ২০০৯ সালের দিকে এক গবেষণায় দেখান যে, হিন্দু পুরুষ শ্রমিকরা তাদের মুসলমান সহকর্মীদের চেয়ে আয় করেন, কারণ তারা গড়পড়তায় বেশি শিক্ষিত, কিন্তু তারা বৈষম্যের শিকার হন এবং যোগ্যতা অনুযায়ী প্রত্যাশার চেয়ে কম উপার্জন করেন।

হিন্দুদের প্রতি বৈষম্য সমর্থন করে এমন আইন বাংলাদেশে না থাকলেও, এমন একটি আইন রয়েছে – শত্রু সম্পত্তি আইন ১৯৬৫ এবং এর বাংলাদেশি সংস্করণ – যা হিন্দু সম্প্রদায়কে বিশেষভাবে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়।

যারা দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছেন তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার অনুমতি এই আইন রাষ্ট্রকে দেয়। বাস্তবে দশকের পর দশক ধরে হিন্দুদের সম্পত্তি দখল করতে এই আইনকে ব্যবহার করা হয়েছে। সাধারণত স্থানীয় প্রভাবশালীরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ জমি দখল করেন এবং পরে পরিবারের কোনো সদস্যের মৃত্যু বা অভিবাসনকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে পুরো সম্পত্তিকে তালিকাভুক্ত করে নেন। যদি দেশত্যাগ স্বেচ্ছায় না হয়ে থাকে, তাহলে উপায় হিসেবে জবরদস্তি বা ভয় দেখানো হয়ে থাকে।

আবুল বারাকাতের মতে, ২০০০ সালের আগ পর্যন্ত দুই-পঞ্চামাংশেরও বেশি হিন্দু পরিবার এই আইনের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল; তাদের প্রায় অর্ধেরও বেশি জমি (বাংলাদেশের মোট ৫% এর বেশি জমি) ক্ষতির শিকার হয়েছিল। তবে, এই জমি হস্তান্তরের ফায়দা নিয়েছেন ০.৪% এর চেয়েও কম বাংলাদেশি। গরিব ও দুস্থদের পক্ষে রাষ্ট্রের তরফ থেকে কোনো ভূমি-সংস্কার হয়নি। রাজনৈতিক সংযোগের কারণে শক্তিশালী লোকেরাই এই সুবিধা ভোগ করেছিলেন।

এই অপরাধীদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা কী ছিল? আবুল বারাকাত – যিনি কিনা আওয়ামী লীগের সাথে যুক্ত এবং কথিত আছে যে, ২০০০ সালে লীগের নির্বাচনী প্রচারণার সাথে যুক্ত ছিলেন ও বর্তমান আমলে নানাভাবে পুরষ্কৃত হয়েছেন – এর গবেষণা অনুযায়ী, জমি দখলকারীর ৪৪% এর বেশি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত; সংখ্যাটা বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামের সম্মিলিত যুক্ততার চেয়েও বেশি। এই গবেষণা ২০০০ সালে, আওয়ামীলীগের চলতি ১৫ বছরের শাসনামলের পূর্বেই প্রকাশিত হয়েছিল।
এবং এভাবেই আমরা এমন এক অকার্যকর শাসনব্যবস্থাতে এসে পড়েছি যা বাংলাদেশি হিন্দুদের জন্য অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে। যাবতীয় ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার থাকা সত্ত্বেও এই ২০২৩ সালে বাংলাদেশের হিন্দুদের মঙ্গলের পথে একক সবচেয়ে বড় কাঁটা হলো একটি কর্তৃত্ববাদী ও ক্রমবর্ধমান অকার্যকর শাসনব্যবস্থা, যেখানে সম্প্রদায়ের অধিকাংশ সদস্যকে সম্মিলিত ক্ষমতা কর্তৃক বদযোগ্য অধস্থন (untermensch) হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

যদিও বাংলাদেশে গুজরাটের সাথে তুলনীয় কোনো সহিংসতা ঘটেনি, তবু সহিংসতা হয়েছে। ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে যখন বাবরি মসজিদ গুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, তখন বাংলাদেশজুড়েও মন্দির ভাঙ্গা হয়েছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সহিংসতা মোকাবিলায় রাষ্ট্রযন্ত্রকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

জিয়া নিশ্চয়ই সে অভিজ্ঞতাকে ভালো করেই মনে রেখেছিলেন। ভারতের গুজরাটে যখন দাঙ্গা হচ্ছে তখন তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায়। তার সরকার নিশ্চিত করেছিল, গুজরাটের দাঙ্গার প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপর কোনো প্রতিহিংসামূলক ঘটনা যেন না ঘটে। ২০০১ সালে যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা তার দ্বিতীয় মেয়াদের প্রত্যাবর্তনকে বাধাগ্রস্থ করেছিল সে বিষয়েও তার ছিল তীক্ষ্ণ সচেতনতা।
বাংলাদেশের সংসদে ৩০০টি আসনের মধ্যে প্রায় ৭০টি আসনে হিন্দু ভোটার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে রয়েছেন। যে কোনো হাড্ডাহাড্ডি নির্বাচনী লড়াইয়ে তাদের ভোট বিশাল পার্থক্য গড়ে দেয়। তাদের ভোট না দেওয়াটা তাদের প্রভাব কমানোরই একটা প্রচেষ্টা ছিল; যা ২০০১ সালের নির্বাচনে ঘটেছিল। সে নির্বাচনে বিএনপির ৪১% নির্বাচনের বিপরীতে আওয়ামীলীগ পেয়েছিল ৪০% ভোট। নির্বাচনের পরপর কিছু কিছু জেলাতে হিন্দু ভোটাররা সাম্প্রদায়িক সহিংসতার শিকার হয়েছিলেন।

বাংলাদেশের টানাপোড়নের নির্বাচনী গণতন্ত্র হিন্দু সম্প্রদায়কে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছিল। গল্প অবশ্য সেখানেই শেষ হয়নি।

দুই দশক পরে, ২০০১ সালের ভুক্তভোগীদের ছবি ও গল্পগুলো ২০২১ সালের পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচনে মমতা ব্যানার্জির বিরুদ্ধে চালানো ভুয়া-তথ্য ও প্রপাগান্ডার বিষাক্ত মিশেলে আবারও হাজির হয়েছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠতার গণতন্ত্র যে আদতে নাগরিক অধিকারের সুরক্ষকবচ হতে পারে না, এটাই যেন র‍্যাডক্লিফ লাইনের দুই পারে তাকালে স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে।

অবশ্য গণতন্ত্র পরিত্যাগ করলে যে নিশ্চিতভাবে নাগরিক অধিকার লোপ পায় সেটাও বাংলাদেশের গত দশকের কথা চিন্তা করলেই প্রতীয়মান হয়।

বাংলাদেশে শেখ হাসিনা ওয়াজেদের তথাকথিত সেকুলার ও অন্তর্ভূক্তিমূলক সরকারের অধীনে অসংখ্য সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, যেখানে তার দলীয় লোকেরা সরাসরি উস্কানি না দিলেও সক্রিয়ভাবে প্রশ্রয় দিয়েছিল।

২০২১ সালে দুর্গা পূজার প্রাক্কালে এক মন্দিরে কোরান পাওয়া কেন্দ্র করে শুরু হওয়া সহিংসতার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে ইতিহাসে হিন্দু সম্প্রদায় এমন সমন্বিত আক্রমণ প্রত্যক্ষ করেনি। সে ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর দেশজুড়ে বিভিন্ন মন্দিরে বিক্ষুদ্ধ জনতা হামলা শুরু করে; চারদিনের মধ্যে তিনজন হিন্দু সহ আট জন প্রাণ হারান।

এই সমন্বিত হামলার সময় চাঁদপুরে ছাত্রলীগের নেতা এবং স্থানীয় আওয়ামীলী নেতা শাহিদা বেগমের ছেলে আরিয়ান সাজ্জাদ স্থানীয় মুসলমানদের ‘কোরান অপমান’ এর প্রতিবাদে হিন্দুদের মন্দির ও পূজামন্ডপে হামলার আহ্বান জানান। বান্দরবানে আওয়ামীলীগ নেতা জহিরুল ইসলাম মন্দিরে হামলার শুরুতে উন্মত্ত জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন।

এগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ভারতীয় পুলিশ সার্ভিসের প্রাক্তন অফিসার বিভূতি রাই ভারতের সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সম্পর্কে বলেছিলেন, রাষ্ট্রের সম্মতি ব্যতীত এই ধরনের কোনো ঘটনা চব্বিশ ঘন্টার বেশি স্থায়ী হতে পারে না। যদি বাংলাদেশের সঙ্কুচিত দূরত্বকে আমলে নেওয়া হয়, তাহলে উপর্যুক্ত মন্তব্য আরও কম সময়ের জন্য বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য।

বাংলাদেশি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র ২০১৩ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত হিন্দুদের উপর হামলার ৩৬৭৯ টি ঘটনা নথিভুক্ত করেছে, যার মধ্যে ১৫৫৯টি ঘরভাঙা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা, ১৬৭৮টি মূর্তি, উপাসনালয় ও মন্দির ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা রয়েছে। এই হামলাগুলোতে প্রায় ১১ জন হিন্দু প্রাণ হারিয়েছেন। বাংলাদেশি গণমাধ্যম প্রকাশ করেছে যে, এই ধরনের হামলার সাথে যারা জড়িত তাদের অধিকাংশ আওয়ামীলীগের অনুগত। যেমন, সংসদের ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকুর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা পাবনার একটি হিন্দু গ্রামে পরিকল্পিত হামলা চালিয়েছিল। ২০১৬ সালে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও হাসিনার সাবেক ব্যক্তিগত সহযোগী ওবায়দুল মুক্তাদির চৌধুরীর অনুসারীরা ব্রাম্মণবাড়িয়ার হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েক ডজন বাড়ি ও দোকানপাটে হামলা চালিয়েছিল।

অবশ্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর কোনো হামলার সঠিক তদন্ত করা হয়নি। এতে মোটেও আশ্চর্য হওয়া উচিৎ নয়। বাংলাদেশ প্রায় এক দশক যাবত, এক ব্যক্তির না হলেও, এক দলীয় শাসনের অধীন। হাসিন ওয়াজেদের কর্তৃত্ববাদী শাসন অতিদ্রুত শেষ হয়েও যেতে পারে, অথবা নাও হতে পারে। কয়েক মাসের মধ্যে নির্বাচন হওয়ার কথা, অসন্তোষ বাড়ছে, কিন্তু গত দুইবারের মতো এবারও আরেকটি কারচুপির নির্বাচন করতে পারেন।

এটা আশঙ্কা করার মতো যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, ক্রমবর্ধমান জটিল পরিস্থিতিতে স্বৈরশাসক সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বহুত পুরনো কৌশল ফিরিয়ে আনতে পারেন।

১৯৯০ সালের নভেম্বরে এল কে আদভানি বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার দাবিতে এক পদযাত্রার নেতৃত্ব দেন। ঢাকাতে এরশাদের দলীয় গুণ্ডারা ঢাকেশ্বরী মন্দির ভাঙচুর করে কারফিউ জারি করা ও এরশাদকে একজন রাষ্ট্রনায়কের মতো আচরণ করার অজুহাত তুলে দিয়েছিল। এরশাদের এই চাল ব্যর্থ হয়েছিল, একটি গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে মাস খানেক পরেই তার সরকারের পতন ঘটেছিল।

কয়েক মাস পরে ভারতে হিন্দুত্ববাদী সরকারের তৃতীয় মেয়াদে আসার পটভূমিতে একদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অপপ্রচার চালিয়ে, এবং অন্যদিকে দমন-পীড়নের রাষ্ট্রীয় কলকব্জাকে ব্যবহার করে হাসিনা কী একুশ শতকের উপযোগী করে এই খেলার হালনাগাদ করতে পারেন?

আসন্ন শরতে বাঙালি হিন্দুদের উৎসবের প্রাক্কালে এই অশনি সঙ্কেত নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার জন্য কাউকে ষড়যন্ত্র-তত্ত্বে বাতিকগ্রস্থ হওয়ার দরকার নেই।

পার্টিশনের প্রায় ৭৬ বছর পর বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রয় বলেছেন, “দুঃখজনক হলেও সত্য যে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকেরা আদালত বলেন আর প্রশাসন বলেন, কোথাও গুরুত্ব পায় না। এক কথায় বলা যায়, বাংলাদেশে পাত্তা পায় না। নিরাপত্তাহীনতার কারণে, বাংলাদেশ থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন ক্রমান্বয়ে প্রস্থান করছে”।

প্রায় ৭৭ বছর পূর্বে বঙ্গীয় ব-দ্বীপ সাম্প্রদায়িক সহিংসতার রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল; এক বৃদ্ধ লোক শান্তির বার্তা নিয়ে আসার আগ পর্যন্ত ব্রিটিশ রাজও তা রোধ করতে পারেনি। বাংলাদেশে অবশ্য কোনো মহাত্মা নেই। কিন্তু সেটার দরকারও নেই। রাষ্ট্রযন্ত্র ১৯৯২ বা ২০০২ সালে যা করেছিল, তাই যথেষ্ট হবে।

তবে বাস্তবতা হচ্ছে, গত এক দশক যাবত বাংলাদেশ রাষ্ট্র ভিন্নমতাবলম্বীদের দমনে দক্ষ হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই ধরনের হামলাকে ব্যর্থ করে দেওয়ার জন্য যে রকম রাষ্ট্রীয় সক্রিয়তা ও পদক্ষেপ প্রয়োজন সেগুলোর অবস্থা আরও সঙ্গিন হয়েছে।

যতক্ষণ না পর্যন্ত এই সৎ স্বীকৃতি মিলছে না যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি ভেঙে পড়ছে এবং সেটার পুনর্গঠনের প্রাথমিক ধাপ হিসেবে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রয়োজন, ততক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশকে এই অশনি সঙ্কেত ধাওয়া করবে।

Jyoti Rahman is a Bangladeshi writer. Formerly an economist with Commonwealth Treasury, Australian Department of Foreign Affairs and Trade, and International Monetary Fund, he writes on Bangladesh’s economy and politics.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Leave a comment
scroll to top