Close

ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর আস্থার সঙ্কট যেন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল!

সুস্পষ্টভাবে, ব্যাংকিং খাতে অনাস্থা ও তারল্য সংকটের সাথে পলিসিগত সমস্যার সংযোগ রয়েছে। মেধাহীন নিয়ম, অর্থ মন্ত্রণালয় নির্দেশিত পলিসি, মূল্যস্ফীতি সহায়ক ভুল মুদ্রানীতি, তারল্য সংকট সহায়ক আমানত ব্যবস্থা, খেলাপি সহায়ক ঋণদান, দায়হীন অক্ষম নিয়ন্ত্রণ, সরকার দলীয়দের নতুন ব্যাংক লাইসেন্স দেয়া, বাণিজ্যিক ব্যাংক পরিচালনায় দুর্বিত্তপনার লাগাম পরানোর শক্তিহীনতা সহ সব কাজকর্মেই বাংলাদেশের ব্যাংকের অক্ষমতার চিত্র ফুটে উঠছে।

‘ব্যাংক সমূহে জনগণের আমানত সম্পূর্ণ নিরাপদ রয়েছে’, ‘ব্যাংকে টাকার সংকট হলে দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক’- সংবাদ সম্মেলন করে এমন ঘোষণা সহ জরুরি বিজ্ঞপ্তি এসেছে। বিবি বলেছে বর্তমানে ব্যাংকব্যবস্থায় অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে ১ লাখ ৬৯ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা।

আমরা এখানে দুটা প্রশ্ন রাখতে চাই। বাংলাদেশ ব্যাংক কি চাইলেই বাণিজ্যিক ব্যাংকে নগদ টাকা সরবারহ করতে পারে? আমানতকারীরা যেসব বাণিজ্যিক ব্যাংকে অর্থ ও সঞ্চয় জমা রেখেছে, তাদের সেবার গ্যারান্টি বাংলাদেশ ব্যাংক আগ বাড়িয়ে কেন দিচ্ছে? কেন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো নিজেরা আমানতের নিরাপত্তার ব্যাপারে গ্রাহক যোগাযোগ করেছে না!  

সরকার প্রধানের আগাম দুর্ভিক্ষের ঘোষণা, ২০২৩ সালকে কঠিন বছর ঘোষণা করা, বিএনপির সফল বিভাগীয় গণসমাবেশ, দেশের চলমান বিদ্যুত-জ্বালানি সংকট, অসনীয় উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট সহ বৈশ্বিক মন্দার আভাস ইত্যাদির সম্মিলিত প্রভাবে আগামীতে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার সম্ভাবনা আছে, এমন ভয়ে কেউ কেউ ব্যাংক থেকে অর্থ তুলে ফেলার ভাবনায় তাড়িত হয়ে থাকতে পারেন। এটা ব্যাংকের তারল্য বা নগদের সংকট নয় বরং আস্থার সংকট।

এমতাবস্থায় নিয়ন্ত্রক বা রেগুলেটর হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিৎ বাণিজ্যিক ব্যাংককে এই বলে সতর্ক করা যে- তারা যাতে মাঝারি সহ বড় চেক অনার করার সময় গ্রাহক হয়রানি না করে। যেকোন নগদায়নকে সহজ করে। কোন ব্যাংক যাতে প্রবেশপথে বা অর্থ উত্তোলন বুথের সামনে লিখে না রাখে যে, এক লাখ টাকার বেশি উত্তোলনে এত কর্ম দিবস আগে জানাতে হবে। ৫ লক্ষ টাকার বেশি নগদায়নে যাতে গড়িমসি করা  না হয়, গ্রাহকদের না ঘুরায়। বড় চেক অনারে যে পজেটিভ পে-স্লিপ ব্যবস্থা আছে, সেটার হয়রানিমুক্ত বাস্তবায়ন হয়। মেয়াদি জমা, ফিক্সড ডেপোজিট কিংবা সঞ্চয়ী স্কীম ভাঙাতে কোন ব্যাংক যাতে বাধা না দেয়। কোন ব্যাংকের খারাপ আচরণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব আকারে ছড়িয়ে গেলে আস্থার সংকট গভীর হবে। 

মানুষ বাংলাদেশ ব্যাংকে টাকা রাখে না, ফিক্সড ডেপোজিট সঞ্চয় করে না। ফলে গ্রাহক যে বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছে টাকার বিনিময়ে সেবা চায় তাকেই সেবাটার নিশ্চয়তা দিতে হবে। বিবি’র উচিৎ নিজের রেগুলেটরি ক্ষমতা পোক্ত করা, ব্যাংকিং সেবায় কিংবা অর্থ উত্তোলনে হয়রানি হচ্ছে কিনা, যেসব যাচাই বাছাই করে পদক্ষেপ নেয়া। গ্রাহক যদি বুঝতে পারে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সঠিক সময়ে সঠিক নিয়ন্ত্রণটা করছে না, তাহলে তারল্য সংকট না থাকলেও আস্থার সংকট কিছুতেই কমবে না।  

আস্থার সংকট কেন? উত্তরটা গভীরে গিয়ে খুঁজতে হবে। কয়েকটা উদাহরণ দেই- ‘দুর্বল ১০ ব্যাংক চিহ্নিত, নাম বলেননি গভর্নর’ (ইত্তেফাক ৪ঠা আগস্ট ২০২২)। দুর্বল এই ১০টি ব্যাংকের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিগত কয়েক বছরে ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হয়নি। ফলে গ্রাহকের মনে আশংকা জেগেছে তার ব্যাংকটির কি অবস্থা!

‘৯ ব্যাংক মূলধনও খেয়ে ফেলেছে, ঘাটতি ছাড়াল ১৯ হাজার কোটি টাকা’ ২৮ মার্চ ২০১৮, যুগান্তর। ‘খারাপ অবস্থায় ১০ ব্যাংক’ (১৯ জানুয়ারি ২০২০) বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্যামেলস রেটিং নিয়ে সমকাল প্রতিবেদন। ‘বাড়বাড়ন্ত খেলাপি ঋণ’, ‘সব সুবিধা খেলাপিদের জন্যই’ (১৫ নভেম্বর ২০২২, প্রথম আলো)। বাংলাদেশ ব্যাংক এসব অপব্যবস্থাপনা ও জালিয়াতি থামানোর প্রশ্নে কার্যত অক্ষম ও নিষ্ক্রিয় বলে গণমাধ্যমের এসব খবরে মানূষের মধ্যে আস্থার সংকট প্রবল হবে এটাই স্বাভাবিক।

পরিচালকরা ৬ থেকে ৯ বছর টানা পদে থাকতে পারেন বলে বেসরকারি ব্যাংকে স্বেচ্ছাচারিতা ও জবাবদিহি -হীনতা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। তারা ঋণদান পদ্ধতিকে এবিউজ করছে। জাতীয় সংসদে খোদ মন্ত্রী বলেছেন, পরিচালকরা নিজেদের মধ্যে ঋণ বিতরণ করে লক্ষ কোটি টাকার কাছাকাছি খেলাপি করেছে। বেসরকারি ব্যাংকে এক পরিবারের চার পরিচালক অনুমোদনের আইন সরকার করেছে। যেকোন রাজনৈতিক সংকটে এসব পারিবারিকভাবে পরিচালিত ব্যাংকের ব্যাপারে মানুষের আশংকা আছে। যদি সম্ভাব্য সরকার পরিবর্তন কিংবা রাজনৈতিক অস্থিরতার মুখে আমানত গায়েব করে মালিক-পরিচালকরা পালিয়ে যান, তাইলে আমানতের কি হবে!

অর্থনীতিবিদ ড মইনুল ইসলাম ১৫ নভেম্বর প্রথম আলোতে লিখেছেন, ‘গত সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকার যে হিসাব দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক, তা মোটেও সঠিক নয়। অবলোপন করা ঋণ, আদালতে মামলা চলছে এমন ঋণ এবং বারবার পুনঃ তফসিল করা ঋণের হিসাব খেলাপি ঋণে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। সব মিলিয়ে দেখলে বর্তমানে খেলাপি ঋণ চার লাখ কোটি টাকার বেশি হবে। খেলাপি ঋণের বড় অংশই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে।’

কৃষি অবকাঠামোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল বেসিক ব্যাংক, ব্যাংকটিকে ধ্বংস করা আবদুল হাই বাচ্চুদের বিচার না হলে ব্যাংকের আস্হার সংকট বাড়বেই। কেবল রাজনৈতিক কারণে ফারমার্স ব্যাংককে পদ্মা ব্যাংক নামে জনগণের অর্থে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। পিপলস লিজিং এর আমানত কবে ফিরে পাবেন গ্রাহকরা! কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতি আস্থা নষ্ট হবে বলে ঘুষ খাওয়ার প্রমাণ পাওয়ার পরও দুই শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থায়ই নেওয়া হয়নি। সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যানও টাকা লোপাট করে পলাতক। ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালক ভাত্রৃদ্বয় বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের পরও সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট। আইসিবি ইসলামি ব্যাংকের অবস্থাও খারাপ। খুব খারাপ অবস্থা সরকারি ব্যাংক গুলোর। ১৫ নভেম্বর প্রথম আলো প্রতিবেদন মতে, ‘মাইশার ঋণে খেলাপি বৃদ্ধির শীর্ষে ন্যাশনাল ব্যাংক’। আস্থাহীনতার দোষ আমানতকারীদের!

খেলাপির সংজ্ঞা পরিবর্তন হয়েছে বারবার। ঋণ পুনঃতফসিলের প্রচলিত ব্যবস্থা তাদের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পরিবর্তিত হয়েছে। অধিকতর সুবিধা দিতে পুনর্গঠন নামক আরেকটি ব্যবস্থা জোরালোভাবে চালু হয়েছে। এমন ব্যবস্থায় ঋণ ফেরতে অতি দীর্ঘমেয়াদি সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। ঋণ পুনঃতফসিল করা হলেও ‘ব্যাংক খাতে এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৩ হাজার কোটি টাকা (১৪ নভেম্বর ২০২২, প্রথম আলো)’। মানুষের কষ্টের টাকা ব্যাংকে রাখবে, আর ব্যাংক ঋণের নামে সেসব হাতানোর কৌশল জারি রাখবে, এসব দেখতে থাকলে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় অনাস্থা কি স্বাভাবিক নয়! ব্যাংকিংখাতে অপশাসন জালিয়াতি লুটপাট ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তপনার মুখে আমানত ও সঞ্চয় ঝুঁকির ভয় তৈরি অবধারিত ছিল! এখন দরকার ড্যামেজ কনট্রোল!

অভিযোগ আছে, সঞ্চয়পত্রের মুনাফা এখন সরাসরি ব্যাংক দেয় না। বাংলাদেশ ব্যাংকে রিকুইজিশন দিয়ে আনতে  বাড়তি সময় লাগে। পদ্ধতিগত ঝামেলায় অনেকে বেকায়দায় পড়ছেন, বিভ্রান্তও হচ্ছেন। এদিকে ডলারের বাস্তব সমস্যার কারনে, পন্য আমদানির এলসি বা ঋণপত্র বন্ধে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা সমস্যায় আছে। এইসব মিলে ব্যাংক ব্যবস্থার উপর মানূষের আস্থা উঠে যাচ্ছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকের উপর অনাস্থা আসলে এমনি এমনি আসেনি।

বাংলাদেশে কয়েক বছর থেকেই ব্যাংক আমানতের সুদের চেয়ে মূল্যস্ফীতি বেশি। ফলে ব্যাংকে টাকা রাখলেই লোকসান। ব্যাংকে টাকা রাখলে গড়ে সুদ পাওয়া যায় ৪ শতাংশের সামান্য বেশি, অথচ সরকারি হিসেবেই মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছাকাছি, বেসরকারি হিসেবে আরও বেশি। বছরশেষে প্রকৃত বিচারে আমানতকারীর কোনো লাভ নেই, বরং সরকারের কর কর্তনের পরে দ্বিতীয় ধাপে লোকসান হয়! ব্যাংকে টাকা রাখলে যদি সেটা কমে যায়, মানুষ অর্থ উঠে ফেলবে এটাই স্বাভাবিক।  

বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিৎ দ্রুত ব্যাংকিং খাতে দুর্বৃত্তপনা বন্ধ করে, আমানতে সুদের হার বাড়িয়ে, খেলাপি ঋণ বন্ধ করে, প্রভাবশালীদের দৌরাত্মের বিপরীতে সঠিক ব্যবসায়ীদের ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করে, ব্যাংকের পুলিশি আচরণ বন্ধ করে, ব্যাংক আমানতে কর কমিয়ে, সঞ্চয়ে সুদ বাড়িয়ে আস্থা তৈরি করা,  গ্রাহকের আমানত সুরক্ষা করার দায়িত্ব নেয়া। অর্থহীন সস্তা কোন বিজ্ঞাপন না দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে রেগুলেটরি কাজে, পলিসিগত কাজে মনোযোগ দেয়ার আন্তরিক পরামর্শ দেই।

বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলেই বাণিজ্যিক ব্যাংকে টাকা সাপ্লাই দিতে পারে না। বাণিজ্যিক ব্যাংকের নগদের সংকট হলে প্রথমে অন্য ব্যাংক থেকে কলমানি রেটে টাকা ধার করবে। সেখানেও না পেলে স্থায়ী আমানতের বিপরীতে একটা হারে সুদে ও শর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার করবে। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক যে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে, সেটার সরল অর্থ অনেকেই ভিন্নভাবে নিতে পারে। চলমান তারল্য সংকটের কিছু কাঠামোগত কারনও আছে।

বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই নিয়ম বহির্ভুতভাবে সরকারের বন্ড কিনে নিয়ে সরকারকে টাকা ছাপিয়ে দিচ্ছে, অথচ বন্ড কেনার কথা বেসরকারি ব্যাংকের। বিধিবিদ্ধ প্রক্রিয়ায় না গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ ছাপানো দেশে মূল্যস্ফীতি তৈরি করছে। প্রশ্ন হচ্ছে, বিবি কি সরকারকে বন্ড ফিরিয়ে দিয়ে সমপরিমাণ অর্থ ‘মানি মার্কেটে’ ফেরত দিতে পারছে?

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটে কারখানা বন্ধ হয়ে বেকারত্ব বেড়েছে। দ্রব্যমূল্যের দাম আকাশ ছোঁয়া। মানুষ সঞ্চয় ভেঙে দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহ করতে বাধ্য হচ্ছে। মূল্যস্ফীতির বিপরীতে সুদের হার অন্তত অর্ধেক বলে আমানতকারীরা ব্যাংকে টাকা রাখতে আগ্রহী হচ্ছে না। একদিকে  নগদায়ন বাড়ছে, অন্যদিকে নতুন জমার হার কমেছে বলে, ব্যাংকে তারল্য কমে যাচ্ছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকে বা খোলা বাজারে ডলার বিক্রি করছে বলেও বাণিজ্যিক ব্যাংকের তারল্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে যাচ্ছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকে নতুন সম্পদ তৈরি না হলে এই অর্থ কেন্দ্রীয় থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকে এমনি এমনি ফিরবে না।

তারল্য ফেরাতে বাণিজ্যিক ব্যাংককে বৈদেশিক রপ্তানি আয়, প্রবাসী আয় বাড়তে হবে। কিংবা বেসরকারি বিদেশি ঋণ আনতে হবে, চলতি বছরে ১৮ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণের দায় বকেয়া রেখে নতুন বৈদেশিক ঋণ কঠিন। রপ্তানি আয় বাড়িয়ে ডলার আয় বাড়ালে, প্রবাসী আয় বাড়ালে- নতুন সম্পদ হিসেবে ডলারের বিপরীতে ব্যাংকে নতুন টাকা আসবে বা তারল্য তৈরি হবে। কিন্তু ব্যাংক রেটের উপর অনাস্থায় রেমিটেন্স হুন্ডিতে চলে যাচ্ছে। সেপ্টেম্বরের পর অক্টোবরেও প্রবাসী আয় কমেছে, অক্টোবরে আট মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন প্রবাসী আয় (৭ দশমিক ৩৭ শতাংশ কম) এসেছে। ইপিবির হিসাবে অক্টোবরে রপ্তানি আয়ও গতবছর একই মাসের তুলনায় কমেছে প্রায় ৮ শতাংশ। (প্রথম আলো ৩রা নভেম্বর)।

এমতাবস্থায় অভ্যন্তরীণ আমানত বাড়ানোর পদক্ষেপ নিয়ে, এবং খেলাপি ঋণ ফেরত এনে তারল্য সংকটের কাঠামোগত সমাধান ছাড়া বিকল্প নাই। বাণিজ্যিক ব্যাংককে অবশ্যই মূল্যস্ফীতির হারের বেশি বা অন্তত সমান হারে সুদ দিতে হবে। নাইলে ব্যাংক দেউলিয়ার ঝুঁকিতে না পড়লেও নগদায়ন বাড়বে। তারল্য সংকট সমাধানের প্রধানতম খাত দুর্বিত্তায়িত প্রশ্রয়ে, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় তৈরি করা খেলাপি ঋণ ফেরানো।

খেলাপি ঋণ না ফিরিয়ে ‘ব্যাংকে টাকার সংকট হলে দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক’- একথা বলার অর্থ ভাল না। এর অর্থ এমনও হতে পারে, একদিকে বিশেষ মালিকানাধীন ব্যাংকের ঋণ ইচ্ছাকৃত খেলাপি করা হবে, অন্যদিকে সরকার পাবলিক মানি বেইল-আউট করে অসৎ মালিকদের ব্যাংক বাঁচিয়ে রাখবে। অতীতে সরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ দিয়ে মূলধন খেয়ে ফেলা বেসরকারি ব্যাংক বাঁচিয়ে রাখার ঘটনা দেখেছি। সরকার পরিবর্তন হলে কিংবা দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা হলে এসব ব্যাংকে রক্ষিত আমানতের কি হবে, তা নিয়ে মানুষের মধ্যে ভয় আছে। তাই বাংলাদেশের ব্যাংকের উচিৎ সস্তা বিজ্ঞপ্তি না দিয়ে, ‘কিভাবে ব্যাংকে টাকা রাখাকে লাভবান করা যায়’- সে ব্যবস্থা করা।

সুস্পষ্টভাবে, ব্যাংকিং খাতে অনাস্থা ও তারল্য সংকটের সাথে পলিসিগত সমস্যার সংযোগ রয়েছে। মেধাহীন নিয়ম, অর্থ মন্ত্রণালয় নির্দেশিত পলিসি, মূল্যস্ফীতি সহায়ক ভুল মুদ্রানীতি, তারল্য সংকট সহায়ক আমানত ব্যবস্থা, খেলাপি সহায়ক ঋণদান, দায়হীন অক্ষম নিয়ন্ত্রণ, সরকার দলীয়দের নতুন ব্যাংক লাইসেন্স দেয়া, বাণিজ্যিক ব্যাংক পরিচালনায় দুর্বিত্তপনার লাগাম পরানোর শক্তিহীনতা সহ সব কাজকর্মেই বাংলাদেশের ব্যাংকের অক্ষমতার চিত্র ফুটে উঠছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক দুবৃত্ত মালিকানা, রাজনৈতিক প্রসাশনের ভূত সরিয়ে, সরকারের ছায়া কেটে একটা স্বাধীন ও সক্ষম প্রতিষ্ঠান হিসেবে আবির্ভূত হোক, এটাই দেশের মানুষের চাওয়া।

তড়িৎ প্রকৌশলী, বুয়েট। টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক। গ্রন্থকার: চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ; বাংলাদেশ: অর্থনীতির ৫০ বছর; অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবিত কথামালা; বাংলাদেশের পানি, পরিবেশ ও বর্জ্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Leave a comment
scroll to top