Close

সংবেদনশীল তথ্য ফাঁসের ভবিষ্যৎ ঝুঁকি আমরা জানি না

প্রযুক্তি সেক্টরে একটা কথা আমরা বলি সেটা হচ্ছে—প্রযুক্তি যে দ্রুত গতিতে এগোয়, আইন আসলে সে গতিতে বদলায় না। কারণ আইন বদলানোর একটা নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া আছে। দেখা যাচ্ছে, প্রযুক্তি দুই বছরের মধ্যেই প্রায় বদলে যায়। কিন্তু একটা আইন দুই বছরের মধ্যে বদলায় কি? তাই প্রযুক্তি যখন বদলে যাচ্ছে, এর সঙ্গে খাপ খাওয়াতে দ্রুত এগোতে হবে। এটা একটা সমস্যা। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বেই এ সমস্যা। আবার অনেক সাইবার অপরাধ কিন্তু আন্তঃদেশীয় ধরনের।

মো. সাইমুম রেজা তালুকদার ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক। নেদারল্যান্ডসের লেইডেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন ও ডিজিটাল প্রযুক্তি বিষয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। সুইডেনের লুন্ড ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমাও অর্জন করেন। তিনি হান্না আরেন্ট হিউম্যানিটিজ নেটওয়ার্কের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ওয়ার্কিং গ্রুপের সদস্য। তার লেখালেখি ও তৎপরতার জায়গা হচ্ছে বিগ ডাটা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ডাটা প্রাইভেসি, অনলাইনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার মতো বিভিন্ন ইস্যু। সাম্প্রতিক তথ্য ফাঁস ও আমাদের ডাটা সিকিউরিটি ব্যবস্থার বিভিন্ন আইনগত বিষয় নিয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে আলোচনা করেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাবিদিন ইব্রাহিম। তাঁর এই সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে বণিক বার্তা-তে।

সরকারি ওয়েবসাইট থেকে নাগরিকের গুরুত্বপূর্ণ সংবেদনশীল তথ্য ফাঁসের অভিযোগ নিয়ে সম্প্রতি দেশ-বিদেশে বেশ আলোচনা হচ্ছে। এর ভবিষ্যৎ ঝুঁকি বা পরিণতি কী হতে পারে?

প্রথমেই বলে রাখা ভালো, পূর্ণাঙ্গ তদন্তসাপেক্ষে আমরা পুরোপুরি বুঝতে পারব ঘটনাটি আসলে কী ঘটেছিল। তবে নাগরিক হিসেবে আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ‘গোপনীয়তার অধিকার’। যেকোনো দেশের নাগরিক বা ব্যক্তির জন্য যদি ব্যক্তিগত তথ্যগুলো অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো জায়গায় যায় অথবা এ তথ্যগুলো এমন ব্যক্তির কাছে ফাঁস হয় যারা হয়তো এর অপব্যবহার করতে পারে, তাতে এক ধরনের ঝুঁকির সৃষ্টি হতে পারে। যেমন ব্যক্তিগত সংবেদনশীল তথ্য বলতে সাধারণত ধরা হয়, ব্যক্তির ফোন নাম্বার, স্থায়ী ঠিকানা, জন্মতারিখ, বায়োমেট্রিক প্রিন্ট, রেটিনা বা কর্নিয়ার ইমেজ ইত্যাদি। সাধারণত এ তথ্যগুলো দিয়ে কোনো আইডি কার্ড, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স ইত্যাদি তৈরি করা হয়। এখন এ তথ্যগুলো যদি এমন কারো কাছে যায় যার উদ্দেশ্য খারাপ বা কোনো অপরাধ সংঘটিত করতে চায়, সে ইচ্ছা করলে এ তথ্য দিয়ে একটি ভুয়া আইডি কার্ড তৈরি করতে পারে। ভুয়া আইডি কার্ডের মাধ্যমে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে। এছাড়া বর্তমানে সারা বিশ্বে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে গুজব, হেট স্পিচ (বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য), ফেক নিউজ (ভুয়া সংবাদ) ইত্যাদির পরিমাণ বাড়ছে। অনলাইন র‍্যাডিক্যালাইজেশন খুব বড় একটা মাথাব্যথার কারণ। কভিড-১৯ মহামারীর সময় আমরা দেখেছি কভিড-সংক্রান্ত অনেক স্বাস্থ্য টিপস ছড়ানো হয়েছে যেগুলো মূলত গুজব ছিল।

যদিও বর্তমানে কিছু ঝুঁকি আমাদের জানা আছে, কিন্তু ভবিষ্যতে কী ধরনের ঝুঁকি আসবে সেটি আমরা জানি না। কেননা যারা সাইবার অপরাধী তারা অত্যন্ত সৃজনশীল। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি বুঝতে সহজ হবে। ‘কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা’ সফটওয়্যারটির নাম হয়তো আপনারা শুনেছেন। অভিযোগ রয়েছে, এ সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে ২০১৬ সালের যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এবং ২০১৭ সালের যুক্তরাজ্যের ব্রেক্সিট-সংক্রান্ত ভোটের সময় ভোটারদের একটি বড় অংশের পারসেপশনকে (দৃষ্টিভঙ্গি) প্রভাবিত করানো সম্ভব হয়েছে। সফটওয়্যারটি মূলত ফেসবুকের মাধ্যমে এক ধরনের সার্ভে (জরিপ) ব্যবস্থা করেছিল। যেখানে বলা হয়েছিল—সার্ভে করলে আপনি নির্দিষ্ট একটা অর্থ পাবেন। তখন অনেকেই ফোন নাম্বার, ই-মেইল আইডি, ঠিকানা ইত্যাদি ব্যক্তিগত তথ্য দিয়েছে। এ তথ্যগুলো পেলে যারা হ্যাকার, তারা কিন্তু আপনার অনলাইনের অনেক তথ্য বের করে ফেলতে পারে। আপনি কোথায় যান, কী পছন্দ করেন, কার সঙ্গে চলেন, রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা (অ্যাফিলিয়েশন) কী, কোন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন, আপনি কোন ঘরানার মানুষ এ রকম অনেক তথ্য কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় পাওয়া যায়। সেখান থেকেই আপনাকে টার্গেট করা সম্ভব। সুতরাং দেখুন, ছোট একটা বিষয় থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বা যুক্তরাজ্যের একটি বিশালসংখ্যক ভোটারের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে উদ্দেশ্যগত বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে। এভাবে তাদের পাবলিক পারসেপশনকে (দৃষ্টিভঙ্গি) সার্থকভাবে পরিবর্তন করা হয়েছে বলে আজকাল বলা হচ্ছে। তার মানে, এ ধরনের ডাটা যদি ফাঁস হয়ে যায় তবে ভবিষ্যতে কত রকমভাবে ব্যবহার হতে পারে তা আমাদের এখনই বলা সম্ভব নয়।

ডিজিটাল বিশ্বের তো কোনো ভৌগোলিক সীমানা চিহ্নিত নেই। অর্থাৎ আমাদের ঝুঁকিটাও বৈশ্বিক পরিসরে। জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইন্টারনেটে কোনো নিরাপত্তাবলয় আছে কিনা? যার তথ্য ফাঁস হলো—এখন সে কী করবে, কোনো আইনি নিরাপত্তার আশ্রয় পাবে কিনা?

সারা বিশ্বেই মূলত এখন ‘রাইট টু প্রাইভেসি’ বা ‘গোপনীয়তার অধিকার’ নিয়ে খুব কথাবার্তা হচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ২০১৮ সালে জেনারেল ডাটা প্রটেকশন রেগুলেশন করেছে। ইইউর অন্তর্গত দেশগুলো তাদের নাগরিকদের ও সংস্থাগুলোর নিজস্ব ডাটাগুলোকে নিরাপত্তা দেয়ার এ পদক্ষেপ নিয়েছে। নর্থ আমেরিকা ও ইস্ট এশিয়ার কিছু দেশ এশিয়া প্যাসিফিক ইকোনমিক কো-অপারেশন (অ্যাপেক) নামে একটি জোট করেছে। জোটটি আন্তর্জাতিক কমন একটি স্ট্যান্ডার্ড করতে একটি ক্রসবর্ডার প্রাইভেসি রেগুলেশন (সিবিপিআর) করেছে। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার জন্যও ডাটা প্রাইভেসির নীতিমালা রয়েছে। বাংলাদেশে এখনো কোনো উপাত্ত সুরক্ষা আইন পাস হয়নি, যদিও এ-সংক্রান্ত একটি খসড়া এরই মধ্যে প্রস্তুত হয়েছে। যতদিন পর্যন্ত আমাদের একটা উপাত্ত সুরক্ষা আইন পাস না হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত এ ধরনের ঘটনা ঘটলে অন্যান্য বিদ্যমান আইন অনুযায়ী কতটুকু সুরক্ষা পাওয়া যাবে সেটা নিয়ে আমাদের পর্যালোচনা করতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বলা হয়েছে, কেউ যদি কারো অনুমতি ব্যতিরেকে কোনো পরিচিতিমূলক তথ্য হাতিয়ে নেয় তবে সেটি একটি অপরাধ। বাংলাদেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনুসারে পারসোনাল ডাটার (ব্যক্তিগত তথ্য) সংজ্ঞা নেই। এ বিষয়ে ২৬ ধারায় পরিচিতিমূলক তথ্যের সংজ্ঞা রয়েছে। তবে সেটি পড়লে আপনি দেখবেন, সেখানে ব্যক্তিগত তথ্যের কথাই বলা হচ্ছে। মনে করুন, একজন সাইবার অপরাধী আপনার ডাটা হাতিয়ে নিল, অনুমতিহীনভাবে প্রবেশ করল বা ডাটাগুলো কাউকে দিয়ে দিল, সেটা একটি অপরাধ। কিন্তু ধরুন, আমি একটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করি, যে প্রতিষ্ঠানটিতে গ্রাহকদের ডাটাগুলো সংরক্ষণ করা। এখন কোনো এক সাইবার অপরাধী আমার প্রতিষ্ঠানে সাইবার হামলা করে গ্রাহকদের সেই ডাটাগুলো হাতিয়ে নিল। এখানে অপরাধটা করেছে সেই সাইবার হামলাকারী। তবে দেখতে হবে যে প্রতিষ্ঠান পরিচালনাকারীর কোনো গাফিলতি ছিল কিনা। গাফিলতি বলতে এখানে সাইবার নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করতে হবে। আমরা অনেকেই মনে করি, সাইবার নিরাপত্তা শুধু একটি টেকনিক্যাল বিষয়। ব্যাপারটা মূলত ওরকম নয়। টেকনিক্যাল বিষয়ের পাশাপাশি এটি প্রতিষ্ঠানের পলিসিগত (নীতিমালার), অপারেশন্স (পরিচালন সংক্রান্ত) ও কালচারের (সংস্কৃতিগত) বিষয়। অর্থাৎ আমরা টেকনিক্যাল ভাষায় বলি, যেকোনো আইসিটি বা তথ্যপ্রযুক্তির সিস্টেমে মোটা দাগে তিনটা অংশ আপনি পাবেন। এগুলো হলো সফটওয়্যার, হার্ডওয়্যার ও হিউম্যান ফ্যাক্টর বা মানুষের সম্পৃক্ততা। এখানে মানুষের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ কেননা দিন শেষে এ মানুষই কিন্তু সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার ব্যবহার করবে। এখন আপনি দুনিয়ার সবচেয়ে উন্নত সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার ব্যবহার করলেও আপনি যদি ঠিকভাবে পরিচালনা করতে না পারেন অথবা যে গ্রাহক আপনার প্রতিষ্ঠানের পরিষেবা গ্রহণ করবে তাদের যদি ডিজিটাল নিরাপত্তাবিষয়ক ন্যূনতম জ্ঞান না থাকে, তবে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভুলের কারণেও প্রতিষ্ঠানের সিস্টেম, সার্ভার, কমিউনিকেশন সিস্টেম, নেটওয়ার্ক কম্প্রোমাইজ বা সাইবার হামলার শিকার হতে পারে। ধরুন, এভাবে আমার প্রতিষ্ঠানের সার্ভার থেকে গ্রাহকদের তথ্য কেউ চুরি করে নিয়ে গেছে, তখন সেখানে আমার হয়তো কিছু ভুল ছিল। হতে পারে আমি আমার প্রতিষ্ঠানের সফটওয়্যার আপডেট করিনি, অথবা নতুন সফটওয়্যারে আপগ্রেড করিনি, আমার কোনো কর্মীর ভুল ছিল বা আমার প্রতিষ্ঠানের হার্ডওয়্যার ঠিক ছিল না, নতুবা দৈনিক যেসব টেকনিক্যাল নিয়ম অনুসরণ করতে হয় সেগুলো পালনের ক্ষেত্রে ব্যর্থতা ছিল। এখন সমস্যাটা হচ্ছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটা যদি আপনি দেখেন, তাহলে ব্যর্থতার জন্য আপনার শাস্তি হবে অথবা এ ধরনের কোনো বিষয় উল্লেখ আছে বলে আমি লক্ষ করিনি। কিন্তু আমাদের যদি একটি উপাত্ত সুরক্ষা আইন থাকত সেখানে এ বিষয়গুলোর প্রতি জোর দেয়া (অ্যাড্রেস করা) যেত।

কয়েক বছর ধরে জ্যামিতিক হারে সাইবার হামলা বাড়ছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘বাংলাদেশ ব্যাংক’-এর রিজার্ভ চুরির ঘটনা ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশই সাইবার নিরাপত্তাকে জাতীয় নিরাপত্তা পলিসির অংশ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আপনি কি মনে করেন বাংলাদেশেও আমাদের ডাটা সুরক্ষা বা আমাদের সাইবার নিরাপত্তাকে জাতীয় নিরাপত্তা পলিসিতে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত?

খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এটি। প্রথম কথা হচ্ছে, আমাদের ন্যাশনাল সিকিউরিটি পলিসিটা (জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল) কী? এ সম্পর্কে আমরা সবাই জানি কি না? এটি প্রণয়ন করা হয়েছে কিনা। যদি প্রণয়ন করা হয়ে থাকে, তবে সেটার মধ্যে এই সাইবার স্পেসটাকেও রাখতে হবে। কেননা আজকাল সাইবার স্পেসেও যুদ্ধ হয়, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা হয়। এখানেও নানা ধরনের আন্দোলনসহ বিভিন্ন কার্যক্রম গড়ে ওঠে। তার মানে এগুলোর সবকিছুই কিন্তু জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আবার একই সঙ্গে নাগরিকদের অধিকার সুরক্ষার বিষয় আছে। কেননা সারা বিশ্বে মানবাধিকারের যে মূলনীতিগুলো গড়ে উঠেছে সেটার সুরক্ষা প্রদানের বিষয়টি রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলের মধ্যে কিন্তু সেটাও থাকতে হবে এবং যাতে সাইবার স্পেসটা নিরাপদ হয়, নাগরিকদের মানবাধিকার সুরক্ষিত থাকে সেটাও আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, আইসিটি আইন বা প্রস্তাবিত ডাটা প্রটেকশন অ্যাক্ট এগুলো আলাদা করে দেখলে হবে না। এ সবগুলো মিলে একটা ইকো-সিস্টেম। অর্থাৎ এখানে মোটা দাগে কয়েকটা বিষয়। একটা হচ্ছে, আপনার উপাত্তের সুরক্ষা। এ-সংক্রান্ত একটা আইন থাকতে হবে। আবার সাইবার অপরাধ যদি ঘটে থাকে আপনার বিরুদ্ধে সেটার জন্য একটা আইন থাকতে হবে। টেকনিক্যাল বিষয়ের পাশাপাশি সাইবার সিকিউরিটি একটি পলিসিগত বিষয়ও, সুতরাং এর জন্যও একটা আইন থাকতে হবে।

আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ হওয়ার পথে অনেক দূর এগিয়েছি। সরকারের এখন পরিকল্পনা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়া। আমরা ক্যাশলেস সোসাইটিও করতে চাই। ক্যাশলেস সোসাইটি হওয়ার ক্ষেত্রে ঝুঁকিটা আরো বাড়েছে। দেখা গেল, কারো অ্যাকাউন্টের সব টাকা গায়েব হয়ে গেল। যদি কারো আর্থিক ক্ষতি হয়, টাকা যদি চুরি হয়, একজন নাগরিকের সেফটিনেট আছে কিনা, সে টাকা উদ্ধার করতে পারবে কোনোভাবে?

প্রযুক্তি সেক্টরে একটা কথা আমরা বলি সেটা হচ্ছে—প্রযুক্তি যে দ্রুত গতিতে এগোয়, আইন আসলে সে গতিতে বদলায় না। কারণ আইন বদলানোর একটা নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া আছে। দেখা যাচ্ছে, প্রযুক্তি দুই বছরের মধ্যেই প্রায় বদলে যায়। কিন্তু একটা আইন দুই বছরের মধ্যে বদলায় কি? তাই প্রযুক্তি যখন বদলে যাচ্ছে, এর সঙ্গে খাপ খাওয়াতে দ্রুত এগোতে হবে। এটা একটা সমস্যা। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বেই এ সমস্যা। আবার অনেক সাইবার অপরাধ কিন্তু আন্তঃদেশীয় ধরনের।

বিশ্বে এখন কিন্তু সাইবার আইন নিয়ে সার্বিক কোনো আন্তর্জাতিক কনভেনশন নেই। এটি একটি সমস্যা। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রগুলো অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে Mutual Legal Assistance Treaty (MLAT) করছে। যেহেতু আমি আইন ও প্রযুক্তি খাতে কাজ করি, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাতেই দেখেছি—অনেক মেয়ে অনলাইনে হয়তো সেক্সটিং বা পর্নোগ্রাফি বা সেক্সটরশন এগুলোর শিকার হয়েছে। হয়তো তারা আমাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর কাছে গেছে এবং তাদের পূর্ণ সহায়তা পেয়েছে। তদন্ত করতে গিয়ে পাওয়া গেল যিনি অপরাধী তিনি হয়তো অন্য একটা দেশে বসে আছেন। এখন আমাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সে দেশের কাছে অপরাধীর তথ্য দেয়ার অনুরোধ পাঠাতে পারে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আরেকটা যেটা করতে পারে সেটা হলো, যে প্লাটফর্মে এ অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, যেমন হোয়াটসঅ্যাপ বা ফেসবুক, তাদের কাছে অপরাধীর ডাটা চাইতে পারে। সে প্লাটফর্ম যদি ডাটা না দেয় তাহলে বেশি কিছু করার নেই, কারণ সে প্লাটফর্ম তো বাংলাদেশে নিবন্ধিত না। যে দেশে অপরাধী বসে আছে, সে দেশের সঙ্গে যদি বাংলাদেশের MLAT না থাকে, অথবা ধরুন যদি বন্দি বিনিময় চুক্তি না থাকে, তাহলে আমরা হয়তো বেশি দূর এগোতে পারব না। যতই আমাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আন্তরিকভাবে চেষ্টা করুক না কেন, দিনশেষে আমরা হয়তো কোনো ভিক্টিমকে হেলপ করতে পারব না। এ জায়গাটা কিন্তু এখনো বৈশ্বিকভাবে অমীমাংসিত।

বাংলাদেশের নাগরিকদের তথ্য ফাঁসের ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় নিরাপত্তার জন্য কী করতে পারে?

আমি মনে করি, যেকোনো ধরনের সংকট কিন্তু সম্ভাবনার সৃষ্টি করে। একটা ম্যাসিভ স্কেলে (গণহারে) আপনার ডাটা লিক হওয়ার যে অভিযোগ পাওয়া গেছে, সেটি তদন্তসাপেক্ষে জানা যাবে আসলে কী ঘটেছিল। এটা নিয়ে আমরা যত বেশি কথা বলব, যত বেশি বিশ্লেষণ করব, সাধারণ মানুষের পর্যায় পর্যন্ত এক ধরনের সচেতনতা গড়ে উঠবে। ‍দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যারা আছেন তাদের কাছেও একটা বার্তা যাবে যে এ ধরনের ঘটনা যদি ঘটে তাহলে প্রতিষ্ঠানের জন্য একটা বিপর্যয় সৃষ্টি হতে পারে। তদন্তসাপেক্ষে যদি বের হয় যে আসলে কী ঘটনা ঘটেছিল, তাহলে সেটার মাধ্যমে আমরা নতুন করে জানতে পারব যে হ্যাঁ এভাবেও ডাটা ফাঁস হতে পারে। এখন সরকারের উচিত হবে আমাদের নতুন যে উপাত্ত সুরক্ষা আইনের খসড়া হয়েছে, সেটা নিয়ে আরো বেশি আলোচনা করা এবং মানবাধিকারকর্মী, শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, কারিগরি বিশেষজ্ঞ এ রকম বিভিন্ন অংশীজনকে নিয়ে বসা। বসার পর এই যে একটা ঘটনার অভিযোগ সেটির বিস্তারিত তদন্তসাপেক্ষে প্রকাশ করুক। তারপর সেটা নিয়ে বিশ্লেষণ করে নতুন যে উপাত্ত সুরক্ষা আইন আসছে সেটাতে আমরা আরো সুরক্ষামূলক যে ব্যবস্থা বা পদ্ধতি তা আরো সমৃদ্ধ করতে পারি। সেটা কারিগরি, আইনি, প্রশাসনিক, পরিচালনা পদ্ধতি হতে পারে। এভাবে যত বেশি আলোচনা করব এবং আইনের মধ্যে প্রবেশ করাব আমরা তত বেশি আমাদের সুরক্ষাকে উঁচু স্তরে নিয়ে যাব। স্মার্ট বাংলাদেশ আসলে এভাবেই সম্ভব। প্রতিটা অংশীজন যখন এ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেন এবং তাদের জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে একটা আইন, বিধি ও নীতিমালা তৈরি করব, তখনই আসলে একটা সত্যিকারের সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আমরা প্রণয়ন করতে পারব।

Mr. Md. Saimum Reza Talukder is currently serving as the Senior Lecturer, School of Law, BRAC University, Bangladesh. He is an enrolled lawyer at the Bangladesh Bar Council and a member of the Dhaka District Bar Association. Mr. Saimum has completed LL.M. and LL.B. from the University of Chittagong, Bangladesh and holds a specialized Master’s degree in Law and Digital Technologies from Leiden University, Netherlands. He also obtained a Postgraduate Diploma in Social Innovation in a Digital Context (SIDC) from Lund University, Sweden. Mr. Saimum also holds a Diploma in “Economic, Social and Development Rights (ESDR)” from the Kathmandu School of Law.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Leave a comment
scroll to top